Search Suggest

ন্যায্য প্রত্যাশার মতবাদ (Legitimate Expectation) এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা

 


ন্যায্য প্রত্যাশার (Legitimate Expectation) মতবাদ কি

আদালত প্রশাসনিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করার জন্য যে কয়েকটি হাতিয়ার ব্যবহার করে, তার মধ্যে 'ন্যায্য প্রত্যাশা' মতবাদ অন্যতম। এই মতবাদ একজন ব্যক্তি এবং প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে সম্পর্কের সাথে সম্পর্কিত। এই মতবাদের মতে, কোনো 'ন্যায্য প্রত্যাশা' থাকলে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা যায়। অতীতের কোনো সুস্থির অনুশীলন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতির কারণে কোনো ব্যক্তির প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দিষ্ট উপায়ে আচরণের যুক্তিযুক্ত বা ন্যায্য প্রত্যাশা থাকতে পারে।

এখানে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে:

  • ন্যায্য প্রত্যাশা: এটি আইনগত অধিকার নয়, বরং এমন কিছু যা যুক্তিযুক্তভাবে আশা করা যায়।
  • প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ: সরকারি বিভাগ, সংস্থা বা কর্মকর্তা যারা প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
  • সুস্থির অনুশীলন: প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের অতীতের এমন আচরণ যা বারবার ঘটে থাকে এবং সে অনুযায় ভবিষ্যতেও একই আচরণের আশা করা যায়।
  • সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি: প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের এমন একটি ঘোষণা যা ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট উপায়ে কাজ করার ইঙ্গিত দেয়।

'ন্যায্য প্রত্যাশা' মতবাদ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করার একটি উপায়। যদি কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যক্তির ন্যায্য প্রত্যাশা ভঙ্গ করে, তাহলে আদালত সেই কাজ পর্যালোচনা করতে পারে এবং যদি প্রয়োজন হয় তাহলে প্রতিকার প্রদান করতে পারে।

খুব সহজ ভাষায় বলা যায়, যখন সরকারি কর্তৃপক্ষ কাউকে কোনো আশ্বাস দেয় এবং সেই আশ্বাস অনুযায়ী কেউ কাজ করে এবং কাজ শেষ হলে উক্ত আশ্বাস অনুযায়ী সরকারি কর্তৃপক্ষ তার দায়িত্ব পালন করবেন বলে প্রত্যাশা করেন সেটাকেই মূলত: বৈধ প্রত্যাশা বলে। সরকারি কর্তৃপক্ষ উক্ত আশ্বাস পূরণ থেকে বিরত থাকলে বা উক্ত ব্যক্তির প্রত্যাশা পূরণে  কাজ করে না, তখন সেই ব্যক্তির হতাশা রোধ করে তার অধিকার রক্ষার জন্যই ন্যায্য প্রত্যাশার মতবাদটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়ায় । এটি বুঝতে, চলুন কয়েকটি উদাহরণ দেখি:

উদাহরণ ১: পুনর্বাসন প্রকল্প:

ধরুন সরকার একটি বন্যা-প্রবণ এলাকার মানুষের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্প ঘোষণা করে। প্রকল্পের অংশ হিসেবে তাদের নতুন বাড়ি দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়। এই আশ্বাসের কারণে লোকজন নিজেদের পুরনো বাড়ি ছেড়ে দিয়ে, সাময়িক শিবিরে থাকতে শুরু করে। কিন্তু কয়েকমাস পর সরকার ঘোষণা করে যে অর্থের অভাবে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে লোকজনের একটি কঠিন ন্যায্য প্রত্যাশা লঙ্ঘন হয়েছে। সরকারের আশ্বাসের কারণে তারা তাদের পুরনো বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে, এবং এখন তারা উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। আদালত এই মতবাদ ব্যবহার করে সরকারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বা অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার নির্দেশ দিতে পারে।

উদাহরণ ২: লাইসেন্স বাতিল:

একজন ব্যক্তি সঠিকভাবে আইন মেনে চলে সরকার থেকে একটি ব্যবসার লাইসেন্স লাভ করে। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই, বা কোনো পূর্ব-শুনানি ছাড়াই সরকার হঠাৎ তার লাইসেন্স বাতিল করে দেয়। এই ক্ষেত্রে ব্যক্তির একটি  ন্যায্য প্রত্যাশা লঙ্ঘন হয়েছে। সরকার তাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই, কোনো কারণ না দেখিয়েই লাইসেন্স বাতিল করেছে। আদালত সরকারকে পুনর্বিবেচনা করার, বা লাইসেন্স পুনরুদ্ধার করার নির্দেশ দিতে পারে।

যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ

  • ন্যায্য প্রত্যাশা প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। এটি নির্দিষ্ট শর্ত ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।
  • আদালতই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় যে কোনো ক্ষেত্রে ন্যায্য প্রত্যাশা লঙ্ঘন হয়েছে কি না।
  • এই মতবাদ সরকারি কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকাতে এবং জনগণের অধিকার রক্ষা করতে সাহায্য করে।

যৌক্তিক আশা প্রয়োজন:

যেমন, কোনো ব্যক্তির মনে যে আশা জন্মেছে তা যুক্তিযুক্ত বা সঠিক হতে হবে। যদি কোনো সাধারণ এবং বিচক্ষণ মানুষ কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একই ধরনের সাড়া বা আচরণ আশা করে, তাহলে সেই আশাকে যুক্তিযুক্ত বলা যায়। তবে, যদি আশাটি কোনো নির্দিষ্ট অতীতের ঘটনা থেকে উদ্ভূত না হয়, তাহলে এটিকে যুক্তিযুক্ত বলা যাবে না। তাই, আদালত আশার বৈধতার প্রশ্নটিকে একটি বাস্তবতার প্রশ্ন হিসেবে বিবেচনা করে এবং জনস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে মীমাংসা করে। একজন ব্যক্তির আশার বৈধতা কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায়িত্বের উপর নির্ভর করে না। বরং, আশার বৈধতা নির্ধারিত হয় আইন, রীতি-নির্দেশ, বা অন্ততপক্ষে কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির উপর নির্ভর করে, যদি সেই পদ্ধতিটি ধারাবাহিক থাকে।

চলুন একটি মামলার আলোকে মতবাদটি স্পষ্ট করা যাক-

এই মামলায়, আবেদনকারীরা ২০০৩ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রকল্পে নিয়োগের জন্য লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু প্রকল্পটি শুরু না হওয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। ২০১৭ সালে প্রকল্পটি পুনরায় শুরু হলে, আবেদনকারীরা নিয়োগের জন্য আবারও আবেদন করেন। কিন্তু তাদের নিয়োগ না দিয়ে অন্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

আবেদনকারীরা আদালতে মামলা দায়ের করে বলেন যে তারা আগের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে এবং নতুন প্রকল্পে খালি পদ রয়েছে, তাই তাদের সরাসরি সেসব পদে নিয়োগ দেওয়া উচিত। তারা 'ন্যায্য প্রত্যাশা মতবাদ' (legitimate expectation doctrine) এর উপর ভিত্তি করে এই দাবি করেন।

আদালতের সিদ্ধান্ত:

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে রায় দেয়। রায়টিতে বলা হয়, সরকারের আশ্বাসের কারণে মনোনীত প্রার্থীরা যুক্তিসঙ্গতভাবে ন্যায্য প্রত্যাশা গড়ে তুলেছিল। তাই সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নিয়োগ না দেওয়া বেআইনী ছিল। আদালত সরকারকে মনোনীত প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

কিন্তু সরকার পক্ষ আপীল করলে হাইকোর্ট বিভাগের রায় আপীল বিভাগ বাতিল করেন। আপীল বিভাগ এই মামলায় 'ন্যায্য প্রত্যাশা মতবাদ' প্রয়োগ করেননি। কারণ, আবেদনকারীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কারণে কোনো আইনগত অধিকার তৈরি হয়নি। তারা শুধুমাত্র একটি আশা (expectation) তৈরি করেছিলেন যে তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু এই আশাটি স্থায়ী ছিল না। কারণ, প্রকল্পটি শুরু না হওয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে গিয়েছিল।

এছাড়াও, আদালত বলেছেন যে ন্যায্য প্রত্যাশা সরকারি নীতি পরিবর্তনকে বাতিল করতে পারে না। এই মামলায়, সরকার বিকল্প চিকিৎসা সেবা (AMC) প্রকল্পের জন্য নতুন নিয়োগ নীতি প্রণয়ন করেছে। এই নীতি অনুযায়ী, নিয়োগের জন্য সবার কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হবে এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া আইনসম্মতভাবে হবে। আবেদনকারীদের আগের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কারণে এই নতুন নীতিটি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

সুতরাং, আদালত এই মামলায় আবেদনকারীদের দাবি খারিজ করে দেয়।

আপীল বিভাগের সিদ্ধান্তের মূল কারণগুলো হলো:

  • ন্যায্য প্রত্যাশার ধারণা: আপীল বিভাগ মনে করেন যে ন্যায্য প্রত্যাশার ধারণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি নীতি, কিন্তু এটি সর্বদা কার্যকর হয় না। ন্যায্য প্রত্যাশার লঙ্ঘন হলেও, তা যদি আইনের অনুসারী হয়, তাহলে আদালত তার প্রতিকার দিতে পারে না।
  • নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্থগিতাদেশ: আপীল বিভাগ মনে করে যে প্রকল্পটি শুরু না হওয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হওয়ায় এবং তাদেরকে নিয়োগ প্রদান না করায় ‍শুধুমাত্র পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করায় আবেদনকারীদের ন্যায্য প্রত্যাশা স্থায়ী হয়নি। তাই সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নিয়োগ না দেওয়া বেআইনী ছিল না।
  • নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুনরায় শুরু: আপীল বিভাগ মনে করে যে নিয়োগ প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হলে, পূর্বের মনোনীত প্রার্থীদের ছাড়াও অন্যদের নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে। তাই মনোনীত প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার পূর্বে অন্যদেরও সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

নজীর সমূহ

আপীল বিভাগ তার সিদ্ধান্তে নিম্নলিখিত নজীর সমূহ উল্লেখ করেছেন:

  • Secretary, Ministry of Fisheries and Livestock and others Vs. Abdul Razzak and others, reported in 71 DLR (AD), Page-395: এই মামলায় আপীল বিভাগ বলেছেন যে, "ন্যায্য প্রত্যাশার নীতিটি আইনের উপর ভিত্তি করে থাকতে হবে। যদি কোন পদক্ষেপ আইনের অনুসারী না হয়, তাহলে ন্যায্য প্রত্যাশার নীতি প্রয়োগ করা যায় না।"
  • The Director General, represented by Bangladesh Rural Development Board (BRDB), Dhaka Vs. Asma Sharif, Shariatpur and others, reported in 72 DLR (AD), Page-188: এই মামলায় আপীল বিভাগ বলেছেন যে, "কোন পদক্ষেপের ফলে যদি কোন ব্যক্তির ক্ষতি হয়, তাহলে শুধুমাত্র সেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ন্যায্য প্রত্যাশার নীতি প্রয়োগ করা যায় না।"

এই মামলার নজীরগুলো থেকে বোঝা যায় যে ন্যায্য প্রত্যাশা মতবাদ প্রয়োগের ক্ষেত্রে আদালত বেশ কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করেন। আবেদনকারীদের দাবি কতটা সুপ্রতিষ্ঠিত, দাবিটি কি জনস্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, দাবিটি কি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ, সরকারের নীতি পরিবর্তনের কারণে দাবিটি কি লঙ্ঘিত হয়েছে, নিয়োগের জন্য সবার কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হয়েছে কি না, নিয়োগ প্রক্রিয়া আইনসম্মতভাবে হয়েছে কি না - এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে আদালত ন্যায্য প্রত্যাশা মতবাদ প্রয়োগ করে কি না তা নির্ধারণ করে।

উপসংহার

আপীল বিভাগের সিদ্ধান্তটি ন্যায্য প্রত্যাশার ধারণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা। এই সিদ্ধান্তটি থেকে বোঝা যায় যে ন্যায্য প্রত্যাশার ধারণাটি সর্বদা কার্যকর হয় না। ন্যায্য প্রত্যাশার লঙ্ঘন হলেও, তা যদি আইনের অনুসারী হয়, তাহলে আদালত তা প্রতিকার দিতে পারেন না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন