বাবা সব সম্পত্তি অন্য ওয়ারিশদেরকে উইল করে দিলে যা করবেন

ইংরেজি উইল শব্দের আরবী প্রতিশব্দ হলো অসিয়ত। অসিয়ত শব্দের অর্থ হলো- মিশ্রণ করা, কল্যাণ কামনা করা। আর শরিয়তের পারিভাষিক অর্থ- মৃত্যুর পরের জন্য নিজের মালিকানার কিছু অংশ বিনিময় ব্যতিরেকে কাউকে দিয়ে দেয়া। শাব্দিক অর্থে যে কোন কাজ করার নির্দেশ প্রদানকে অসিয়ত বলা হয়। কোন ব্যক্তি তার মৃত্যুর পূর্বেই তার সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা করে যাওয়াই হলো উইল বা অসিয়ত।
আমাদের সমাজে অনেক পিতাই আছেন যারা তার অন্য সন্তানদেরকে বঞ্চিত করে সকল সম্পত্তি অন্য ওয়ারিশদের নামে অসিয়ত বা উইল করে যান। আবার এমনটাও হরহমেশাই ঘটে যে, বৃ্দ্ধ বাবা মা কে চাপ প্রয়োগ করে কোন কোন সন্তান সকল সম্পত্তি নিজেদের নামে উইল করাতে বাধ্য করেন। আবার কখনো কখনো এটাও দেখা যায় যে, পিতা বা মাতা মারা যাওয়ার পরে হঠাৎ কোন কোন ওয়ারিশ একটি অসিয়তনামা বা উইল বের করে দাবি করেন যে তার বা তাদের পিতা বা মাতা মৃত্যুর আগে সকল সম্পত্তি তাদের নামে উইল বা অসিয়ত করে গেছেন। যখন কোন কোন ওয়ারিশ এমন দাবি করে থাকেন তখনই দেখা দেয় বিভিন্ন জটিলতা। মারামারি,হানাহানি  বা রক্তপাতের মত ঘটনাও ঘটে। এসব কিছুই ঘটে পিতা বা মাতা মারা যাওয়ার পর। কারণ যিনি অসিয়ত বা উইল করেন তিনি মারা যাওয়ার পরই সেই উইল কার্যকর হয়। এজন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসিয়ত বা উইল এর বিষয়টি গোপন থেকে যায়। আজ আমরা একটি মামলা নিয়ে আলোচনা করবো যেটি [৯ এসসি ও বি (২০১৭) এডি ৪০] তে রিপোর্টেড হয়েছে।

বাদীর দাবী

হাজী মনিরুদ্দিন সরকারের দুই স্ত্রী। কোন স্ত্রীরই ছেলে সন্তান নেই। দুই স্ত্রীর ঘরে মোট চারজন কন্যা সন্তান। কাজেই তৃতীয় বিয়ে করার জন্য হাজী মনিরুদ্দিন সরকার উঠেপড়ে লাগলেন। কিন্তু এই তৃতীয় বিয়েতে তার দ্বিতীয় স্ত্রী সম্মতি না দেওয়ায় তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার কন্যা সন্তানকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। মনিরুদ্দিন সরকারের দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার কন্যা তখনকার মার্শাল ল কর্তৃৃপক্ষের নিকট অভিযোগ জানালে মার্শাল ল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করার পর হাজী মনিরুদ্দিন সরকারকে কিছু সম্পত্তি তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার কন্যার নামে হস্তান্তরের আদেশ দেন। ফলে হাজী মনিরুদ্দিন সরকার সাফ কবলা দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে তার কিছু সম্পত্তি তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও কন্যা কে হস্তান্তর করেন। হাজী মনিরুদ্দিন সরকার কৗশলে কিছু অলিখিত কাগজে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও কন্যার স্বাক্ষর নিয়ে রাখে। অতঃপর ঐ অলিখিত খালি কাগজগুলোকে নাদাবীপত্র তৈরীর কাজে ব্যবহৃত হয় যেটি থেকে জানা যায় যে, হাজী মনিরুদ্দিন সরকারের দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার কন্যা হাজী মনিরুদ্দিন সরকারের সকল সম্পত্তি হইতে মালিকানার দাবি ত্যাগ করেছেন যা মিথ্যা এবং বানোয়াট। পরবর্তীতে হাজী মনিরুদ্দিন সরকার মারা যাওয়ার পর তিন স্ত্রী ও চার কন্যা রেখে মারা যান। চার কন্যার মধ্যে এক কন্যা রাকিব নামে এক পুত্র রেখে মারা যায়। হাজী মনিরুদ্দিন সরকার মারা যাওয়ার পর তার দ্বিতীয় স্ত্রী সাকসেশন মামলা করলে উক্ত মামলায় হাজী মনিরুদ্দিন সরকারের প্রথম স্ত্রী ও তার তিন কন্যা এবং মৃত কন্যার পুত্র রাকিব প্রতিদন্দিতা করেন এবং একটি ওসিয়তনামা আদালতে দাখিল করে বলেন যে হাজী মনিরুদ্দিন সরকার মারা যাওয়ার আগে কিছু সম্পত্তি মসজিদের নামে এবং কিছু সম্পত্তি রাকিবের নামে অসিয়ত করে গিয়েছেন। বাদীর দাবি ঐ অসিয়তনামাটি জাল এবং অবৈধ। এজন্য তিনি অত্র মামলাটি দায়ের করেন ঐ অসিয়তনামাটি বাতিল ঘোষণার জন্য।

বিবাদীর দাবী

বিবাদীগন বাদীর কিছু বক্তব্য স্বীকার পূর্বক লিখিত জবাবে বলেন যে, বাদীগণ স্বেচ্ছায় নাদাবিপত্র সম্পাদন করেছেন। উপরোক্ত অসিয়তনামা জাল নয়। হাজী মনিরুদ্দিন সরকার মারা যাওয়ার পূর্বে তার কিছু সম্পত্তি মসজিদের নামে এবং কিছু সম্পত্তি রাকিবের নামে অসিয়ত করে গিয়েছেন। বিচারিক আদালত যথাযথ পক্ষের অভাবে এবং উপরোক্ত না দাবীপত্র বিবেচনায় মামলাটি খারিজ করে দিলে বাদী উচ্চ আদালতে আপীল দায়ের করেন। আপীলটিও খারিজ হলে মহামান্য  হাইকোর্টে  রিভিশন দায়ের করেন। 
মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ রিভিশনটি মঞ্জুর করেন এই ভিত্তিতে যে,
কোন ব্যক্তি তার সৎকারের জন্য এবং  তার ঋণ পরিশোধের জন্য যে টাকা ব্যয় হয় সে সব ব্যয় ব্যতীত যে সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে সেই সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের বেশি তিনি অসিয়ত করতে পারেন না। এক তৃতীয়াংশের বেশি কিংবা কোন  ওয়ারিশের নামে অসিয়ত করলে উক্ত অসিয়ত অবশিষ্ট ওয়ারিশগণ কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে। নতুবা উক্ত অসিয়ত বৈধ হবে না। যেহেতু হাজি মনিরুদ্দিন সরকার তার ওয়ারিশের নামে যে অসিয়ত করে গেছেন সেই অসিয়ত বাদী স্বীকার করছেন না কাজেই উক্ত অসিয়ত নামা টি বৈধ অসিয়ত হয়নি। এজন্য মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ উক্ত অসিয়তনামাটি অবৈধ বলে ঘোষণা দেন।
মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের উপরোক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিবাদীগণ আপীল দায়ের করে মহামান্য আপীল বিভাগে এই যুক্তি পেশ করেন যে, মুসলিম আইন অনুযায়ী কোন  ব্যক্তি এক তৃতীয়াংশের বেশি সম্পত্তি ওয়ারিশ নয় এমন কোন তৃতীয় ব্যক্তির নামে অসিয়ত করতে পারেন না। এক তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করতে হলে সকল ওয়ারিশদের সম্মতির প্রয়োজন হবে। তাছাড়া কোন ব্যক্তি তার কোন ওয়ারিশের নামে অন্য ওয়ারিশদের সম্মতি ব্যতিরেকে কোন সম্পত্তিই অসিয়ত করতে পারেন না। তার পরিমাণ যাই হোক না কেন। কোন ওয়ারিশের নামে অসিয়ত করা যায়না। কোন ওয়ারিশের নামে অসিয়ত বা উইল করতে হলে অবশ্যই অন্য ওয়ারিশদের সম্মতি নিতে হবে। আলোচ্য ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা প্রয়োজন হাজী মনিরুদ্দিন সরকার কতটুকু সম্পত্তি অসিয়ত করেছেন। হাজী মনিরুদ্দিন সরকারের মোট সম্পত্তি ছিল ৩৭ একরেরও বেশি। তিনি অসিয়ত করেছেন ১২ একর অর্থ্যাৎ এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তি তিনি অসিয়ত করেছেন যে টি তিনি কোন ওয়ারিশের সম্মতি ছাড়াই করার অধিকারী।  দ্বিতীয়ত দেখার বিষয় হাজী মনিরুদ্দিন সরকার মারা যাওয়ার সময় রাকিব হাজী মনিরুদ্দিন সরকার এর ওয়ারিশ ছিল কিনা। হাজী মনিরুদ্দিন সরকার মারা যাওয়ার সময় রাকিবের মা বেচে ছিল। অর্থ্যাৎ রাকিব নয় বরং তার মা ঐ সময় হাজী মনিরুদ্দিন সরকার এর ওয়ারিশ ছিল। রাকিব হাজী মনিরুদ্দিন সরকার এর ওয়ারশ ছিল না বিধায় হাজী মনিরুদ্দিন সরকার এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তি রাকিবের নামে হস্তান্তর করতে আইনত অধিকারী।
মহামান্য আপীল বিভাগ বিবাদীপক্ষের উপরোক্ত যুক্তিতে একাত্বতা ঘোষণা করে অভিমত দেন যে, 
মুসলিম আইন অনুযায়ী কোন ব্যক্তি কোন ওয়ারিশের নামে অসিয়ত করতে পারেন না যদি না অন্য ওয়ারিশগণ উহাতে সম্মতি দেন। এছাড়া কোন ব্যক্তি তার সৎকারের জন্য এবং  তার ঋণ পরিশোধের জন্য যে টাকা ব্যয় হয় সে সব ব্যয় ব্যতীত যে সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকে সেই সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের বেশি তিনি অসিয়ত করতে পারেন না।এক তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করতে হলে সকল ওয়ারিশদের সম্মতির প্রয়োজন হবে।
সার্বিক বিবেচনায় আপীল বিভাগ এই সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে, উপরোক্ত অসিয়তনামাটি বৈধ এবং আইন সম্মত।
পাঠক, যদি কখনো দেখেন যে, আপনার পিতা বা মাতা বা এমন কোন ব্যক্তি যার থেকে আপনি ওয়ারিশসু্ত্রে কোন সম্পত্তি পেতে হকদার তার সকল সম্পত্তি ওয়ারিশ ব্যতীত কোন ব্যক্তির নামে অসিয়ত বা উইল করে দিয়েছেন বা কোন ওয়ারিশের নামে যে কোন অংশ অসিয়ত বা উইল করে দিয়েছেন তাহলে উক্ত অসিয়তে আপনার আপত্তি থাকলে উক্ত অসিয়ত বা উইল বাতিল এবং অকাযকর চেয়ে যথাযথ এখতিয়ার সম্পন্ন দেওয়ানী আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারবেন।
আপনার কি কিছু বলার ছিল? তাহলে লিখুন নিচে মন্তব্যের ঘরে

৫টি মন্তব্য

  1. আসসালামু আলাইকুম। স্যার! মনে করুন জামিল সাহেবের ৮জন ছেলেমেয়ে।৪ছেলে ৪মেয়ে। উনার মোট সম্পত্তি ১৩ বিঘা জমি। এই সম্পত্তি থেকে সবার বড় ছেলেকে ৫বিঘা জমি বিক্রি করে সব টাকা দিয়েছেন। ছেলেটা এখন টাকা নিয়ে নিরুদ্দেশ। এক যুগের ও বেশি সময় থেকে বৃদ্ধ বাবা জনাব জামিল সাহেব ও উনার সহধর্মিণীর কোন খুজ খবর ভরণপোষণ করেন না। এমতাবস্থায় বাবা মা'র খোজ খবর/ভরণপোষণের দায়িত্ববহন করছেন বাকি ৭ সন্তানেরা। এখন বৃদ্ধাবস্থায় জনাব জামিল সাহেব চাইছেন উনার বাকি ৮বিঘা জমি অন্যান্য সব ওয়ারিশদের সম্মতিতে (শুধু মাত্র আগের ৫বিঘা জমি নেওয়া ছেলে ছাড়া) উনার পাশে থাকা ৩ ছেলের নামে অসিয়ত/উইল করে যেতে। যদি উনি এরকম অসিয়ত করে যান তাহলে এটা কার্যকর হবে কি না? আর ভবিষ্যতে আগের ৫বিঘা জমি নেওয়া ছেলে বা তাহার ছেলে (জামিল সাহেবের নাতি) এই ৮বিঘা জমিতে ভাগ বাসাতে চাইলে তা আইনিভাবে গ্রহণীয় হবে কিনা? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন
  2. পারবেন। কারণ উনি জীবদ্দশায় দিয়েছেন। উনি মারা যাওয়ার পর বৈধ ওয়ারিশ হিসেবে দাবি করতে পারবেন।
  3. দুঃখিত স্যার! আপনার মন্তব্যটির ঠিক বুঝতে পারিনি দয়া করে যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন অনেক উপকৃত হতাম.
  4. পিতা তার বড় ছেলেকে টাকা দিয়েছে। দিতেই পারে। কিন্তু এই টাকা কি লিখিত কোন শর্ত স্বাপেক্ষে দিয়েছে? বাবা যদি বড় ছেলেকে অসিয়ত এর অংশ না দিয়ে ১/৩ এর বেশি অসিয়ত করলে বড় ছেলে সেই অসিয়ত মানতে বাধ্য নয়। আরো জানতে এই লিংকে যান - https://www.legalvoicebd.com/2018/02/blog-post.html?m=1
  5. রক্তের সম্পর্কের ওয়ারিশ ব্যাতিত অন্য কাউকে সম্পত্তি অসিয়ত করা যায় কিনা ? যেমন- পালিত পুত্র, অথবা ভাই/ বোনের ছেলে/মেয়ে।
Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.