ফৌজদারি মামলায় মেডিকেল রিপোর্ট প্রস্তুতের আইনগত বিধান

মেডিকেল রিপোর্ট হচ্ছে সেই সমস্ত দলিল, যেগুলি পুলিশ অফিসার কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক চাওয়ার পরে মেডিকেল অফিসার তৈরি করেন এবং এইগুলি সাধারনত মারামারি জনিত, জখম, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলার সাথে সম্পৃক্ত থাকে। ফৌজদারি মামলার বিচার কার্যে মেডিকেল রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। মেডিকেল রিপোর্ট সম্পর্কে ধারণা না থাকলে ফৌজদারি মামলার বিচার কার্য্য পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই জন্য আইনজীবী ও বিচারক উভয়কেই মেডিকেল রিপোর্ট সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখতে হয়।

ফৌজদারি মামলায় যে মেডিকেল রিপোর্ট প্রদান করা হয় সেই মেডিকেল রিপোর্ট এর তিনটি অংশ থাকে। যেমন-
১। সূচনা, পরীক্ষার তারিখ, সময় এবং স্থানসহ পরীক্ষিত ব্যক্তির সনাক্তকরণের চিহ্ন, শনাক্তকরণের নাম ইত্যাদি।

২। পরীক্ষা করে যেসব তথ্যাদি পাওয়া যায় সেসব প্রাপ্ত তথ্য।

৩। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেয়া মতামত বা সিদ্ধান্ত।

এই রিপোর্টগুলি ভিকটিমকে পরীক্ষার সময় কিংবা তার অব্যবহিত পরে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক নিজ হাতে এমনভাবে লিখবেন যেন আদালতের সাক্ষ্যের সময়ে এগুলি প্রদর্শিত হতে পারে। কোন সহকারী কর্তৃক লিখিত হলে তিনি তা সত্যায়িত করবেন। বিচার বিভাগীয় তদন্তে এইগুলি প্রধান দলিল হিসেবে আদালতে স্বীকৃত হয় এবং নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে প্রেরণের সম্ভাবনা থাকে এবং তা আইনজীবীদের হাতেও দেয়া হতে পারে। তাই এইসব রিপোর্ট প্রণয়নে অত্যন্ত যত্নশীল ও সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। মেডিকেল রিপোর্টে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন শব্দ ব্যবহার করা উচিত নয়। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ ও বিস্তারিত খতিয়ে দেখে যথাসম্ভব অল্প কথায় এবং পয়েন্ট মত মন্তব্য পেশ করা উচিত।


চিকিৎসক সর্বদা মনে রাখবেন যে তিনি তার মন্তব্য দেবেন শুধুমাত্র তার নিজের পরিলক্ষিত তথ্য থেকে। অন্যের কোন বক্তব্য বিবৃতি বা মতামত দ্বারা তিনি প্রভাবিত হবেন না কিংবা অন্য কোনো সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর নির্ভর করবেন না। রোগীকে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন এবং প্রয়োজনবোধে পুলিশে খবর দিবেন। যদি কোন মতামত ব্যক্ত করতে তিনি অপারগ হন, তাহলে পুলিশ কর্তৃক চাপ প্রয়োগ করা সত্ত্বেও তিনি কোন রিপোর্ট তৈরি করবেন না। যেনতেন করে মতামত প্রদান চিকিৎসকের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। কেননা মতামতের জন্য শুধুমাত্র তাকেই দায়ী করা হবে।

এছাড়া পরীক্ষাকারী চিকিৎসককে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। যেমন-
১। কাপড়চোপড়, অস্ত্র প্রভৃতি যেসব জিনিসপত্র পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হবে, সেগুলি আদালতে প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে যাতে সহজে শনাক্ত করা যায়, তার জন্য প্রত্যেকটি জিনিসের উপর স্পষ্ট অক্ষরে নম্বর লিখে লেবেল এঁটে দিতে হবে।

২। গ্রহণকারী অর্থ্যাৎ যিনি রিপোর্টটি গ্রহণ করবেন (সাধারনত পুলিশ কনস্টেবল) তার স্বাক্ষর থাকতে হবে।

৩। রাসায়নিক পরীক্ষকের নিকট প্রেরণকৃত জিনিস মেডিকেল অফিসারের হেফাজতে তালাবদ্ধ করে রাখতে হবে। আহত ব্যক্তি জীবিত থাকলে তার জখমের পূর্ণ বিবরণ মেডিকেল রিপোর্টে উল্লেখ করতে হবে। যেমন-

(ক) শরীরের কত জায়গায় ক্ষত হয়েছে তার সংখ্যা।

(খ) জখমের ধরণ অর্থ্যৎ কাটা, থেঁতলানো, গুলির আঘাত ইত্যাদি।

(গ) প্রতিটি ক্ষতের বর্ণনা অর্থ্যাৎ ক্ষতের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা, ক্ষতের আনুমানিক বয়স কত, শরীরের কোন কোন জায়গায় ক্ষত হয়েছে তার বর্ণনা।

(ঘ) কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে অর্থ্যাৎ ভোতা, ধারালো, সুচালো, হালকা, খুব ভারী ইত্যাদি।

(ঙ) জখমের প্রকৃতি অর্থাৎ সাধারণ অথবা গুরুতর অথবা মারাত্মক ইত্যাদি।
(চ) মন্তব্য, যদি করা প্রয়োজন হয়।

মৃতদেহ হলে দেহের অভ্যন্তরের ও বহিরাংশে ক্ষত সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ সমূহ। দেহের মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা বর্ণনা করতে হবে। এছাড়া নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর বিবরণ রিপোর্টে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। যেমন-

(ক) মৃত্যুর কারণ, সহায়ক কারণ, যদি থাকে।

(খ) কি ধরনের অস্ত্রের আঘাতের ফলে দেহ জখম হয়েছে।

(গ) আঘাতের কারণ কি- জিঘাংসা মুলক (homicidal), আত্মহত্যামূলক (suicidal), কিংবা দুর্ঘটনা মুলক (accidental) ইত্যাদি।

মেডিকেল রিপোর্ট এর গ্রহণযোগ্যতা

জখম বা ময়নাতদন্ত যে সংক্রান্তই হোক না কেন মেডিকেল রিপোর্ট অবশ্যই নির্ধারিত ফরমে লিখতে হবে এবং নির্দিষ্ট স্থানে জখমের বিবরণ দিতে হবে। প্রমাণ হিসেবে মেডিকেল রিপোর্টের সংশ্লিষ্ট মেডিকেল অফিসার আদালতে হাজির হয়ে আসামির উপস্থিতিতে শপথ গ্রহণ পূর্বক রিপোর্টে বর্ণিত প্রতিটি বিষয়ে মৌখিক সাক্ষ্য না দেওয়া পর্যন্ত জখমের অবস্থা বা ময়না তদন্তের ফলাফল সংক্রান্ত তাঁর প্রদত্ত সার্টিফিকেট বা মেডিকেল রিপোর্ট প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গৃহীত হবে না। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে যেখানে দালিলিক স্বাক্ষ্যও যথেষ্ট। যেমন-

(ক) মৃত্যুকালীন ঘোষণা।

(খ) পুস্তকে প্রকাশিত কোন প্রবন্ধে উদ্বৃত্ত বিশেষজ্ঞের মতামত।

(গ) নিম্ন আদালতে গৃহীত কোনো মেডিকেল সাক্ষীর সাক্ষ্য।

(ঘ) পূর্বের কোন মামলায় সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্য যা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক সত্যায়িত।

(ঙ) রাসায়নিক পরীক্ষকের রিপোর্ট ইত্যাদি।

বিজ্ঞান এর প্রসার ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ প্রমাণ করা অনেকটা সহজ হয়েছে। বিশেষ করে মেডিকেল সেক্টরে অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। একথা আজ নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ফৌজদারি অপরাধ বিশেষ করে খুন, ধর্ষণ, মারাত্মক জখম, ইত্যাদি অপরাধের বিচারকার্যে মেডিকেল রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে অর্থাৎ মেডিকেল রিপোর্ট ছাড়া খুন, ধর্ষণ, জখম ইত্যাদি অপরাধের বিচার বর্তমানে  ছাড়া একরকম অসম্ভব। ফলে আইনজীবী ও বিচারকদের যেমন মেডিকেল রিপোর্ট সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে তেমনি ভাবে যে সকল ডাক্তার মেডিকেল রিপোর্ট প্রস্তুত করেন তাদেরকেও মেডিকেল আইন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখতে হবে।

আপনি কি আমাদের ব্লগে লিখতে আগ্রহী? তাহলে এখানে নিবন্ধন করুন।
আপনার কি কিছু বলার ছিল? তাহলে লিখুন নিচে মন্তব্যের ঘরে।

১টি মন্তব্য

  1. দুইটা হাসপাতালে (১ম হাসপাতাল ২য় হাসপাতালে রেফার্ড করলে) রোগীকে দেখালে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট কোন হসপিটাল ইস্যু করেন জানাবেন প্লিজ।
Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.