মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া টাকার মালিক কে হবেন, নমিনি না উত্তরাধিকারী?

যাদের কোন ব্যাংকে বা ইনস্যুরেন্স কোম্পানীতে একাউন্ট আছে তারা জানেন যে, একাউন্ট খুলতে গেলে 'নমিনি' নামে একটা ঘর পূরণ করতে হয়। নমিনি মানে হচ্ছে মনোনীত ব্যক্তি। কোন ব্যক্তির নামে কোন একাউন্ট থাকলে তার মৃত্যুর পর ঐ একাউন্ট কে পরিচালনা করবেন বা টাকা কে উত্তোলন করতে পারবেন তার একটা ব্যবস্থা করা হয় নমিনির ঘর পূরণ করে। নমিনি যেকেউ হতে পারেন।

পূর্বে আমরা জানতাম কোন ব্যক্তি তার একাউন্টে টাকা রেখে মারা গেলে নমিনিই পাবেন ঐ টাকা। এটা নিয়ে কোন সমস্যার সৃষ্টি হয়নি ইতোপূর্বে। কিন্তু বিগত ০৩/০৪/২০১৬ তারিখে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি রায় এই ব্যাপারে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে সঞ্চয়পত্রের অ্যাকাউন্টধারী মারা গেলে ওই সঞ্চয়ের টাকা নমিনির (মনোনীত ব্যক্তির) পরিবর্তে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী পাবেন। এক সিভিল রিভিশনের শুনানি করে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন।  মামলার ঘটনা হতে জানা যায়,  ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডিরেক্টর সৈয়দ শহীদুল হক তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে ৩০ লাখ টাকার নমিনি করেন। তার মৃত্যুর পর ওই টাকার পুরোটাই দাবি করেন দ্বিতীয় স্ত্রী। এটি চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যান প্রথম পক্ষের সন্তানরা। নিম্ন আদালত নমিনির পক্ষে রায় দেন। পরে প্রথম পক্ষের সন্তানেরা মহামান্য হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন দায়ের করলে উক্ত সিভিল রিভিশন শুনানি শেষে এই রায় দেওয়া হয়। তবে হাইকোর্টের ওই রায় প্রকাশের বেশ কিছুদিন পর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া রায়কে স্থগিত করে দেয়। 

হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ফলে কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানতকারীদের মনোনীত নমিনির কাছ থেকে এই মর্মে অঙ্গীকারনামা নেয় যে, আমানতকারীর মৃত্যুর পর তাঁদের মনোনীত নমিনি মৃত ব্যক্তির হিসাবে রক্ষিত আমানত প্রাপ্তির জন্য যোগ্য বা উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত না-ও হতে পারেন। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিগোচর হলে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২০/০৪/২০১৭ ইং তারিখে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সকল বাণিজ্যিক ব্যাংককে আমানতকারীর মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া টাকা তার নমিনি বরাবর হস্তান্তরের নির্দেশ দেন।

উক্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয় যে, সম্প্রতি কিছু কিছু ব্যাংক আমানতকারীদের মনোনীত নমিনির কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা নিয়েছে যে, আমানতকারীর মৃত্যুর পর তাঁদের মনোনীত নমিনি মৃত ব্যক্তির হিসাবে রক্ষিত আমানত প্রাপ্তির জন্য যোগ্য বা উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত না-ও হতে পারেন। কিন্তু এই অঙ্গীকারনামা ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত)-এর ১০৩ ধারায় নির্দেশনার পরিপন্থী। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসরণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে যে, নমিনি কে টাকা না দেওয়া ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত)-এর ১০৩ ধারায় নির্দেশনার পরিপন্থী। তাহলে আমাদেরকে দেখতে হবে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত)-এর ১০৩ ধারায় কি বলা হয়েছে। কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত)-এর ১০৩ ধারায় বলা হয়েছে-

(১) ব্যাংক-কোম্পানীর নিকট রক্ষিত কোন আমানত যদি একক ব্যক্তি বা যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির নামে জমা থাকে, তাহা হইলে উক্ত একক আমানতকারী এককভাবে বা ক্ষেত্রমত, যৌথ আমানতকারীগণ যৌথভাবে, নির্ধারিত পদ্ধতিতে, এমন একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে মনোনীত করিতে পারিবেন যাহাকে বা যাহাদিগকে, একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর, আমানতের টাকা প্রদান করা যাইতে পারে।

তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণ যে কোন সময় উক্ত মনোনয়ন বাতিল করিয়া নির্ধারিত পদ্ধতিতে অন্য কোন ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিবর্গকে মনোনীত করিতে পারিবেন৷

(২) উপ-ধারা (১) এর অধীনে মনোনীত কোন ব্যক্তি নাবালক হইলে, তাহার নাবালক থাকা অবস্থায় উক্ত একক আমানতকারীর বা যৌথ আমানতকারীগণের মৃত্যুর ক্ষেত্রে, আমানতের টাকা কে গ্রহণ করিবেন তৎসম্পর্কে উক্ত একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণ নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট করিতে পারিবেন৷

(৩) আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনের বা কোন উইলে বা সম্পত্তি বিলি বণ্টনের ব্যবস্থা সম্বলিত অন্য কোন প্রকার দলিলে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপ-ধারা (১) এর অধীনে কোন ব্যক্তিকে মনোনীত করা হইলে বা উপ-ধারা (২) এর অধীন কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট হইলে তিনি একক আমানতকারী বা ক্ষেত্রমত যৌথ আমানতকারীগণের সকলের মৃত্যুর পর, উক্ত আমানতের ব্যাপারে একক আমানতকারীর বা ক্ষেত্রমত, সকল আমানতকারীর যাবতীয় অধিকার লাভ করিবেন, এবং অন্য যে কোন ব্যক্তি উক্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত হইবেন৷

(৪) এই ধারার বিধান অনুযায়ী কোন ব্যাংক-কোম্পানী কর্তৃক টাকা পরিশোধিত হইলে সংশ্লিষ্ট আমানত সম্পর্কিত উহার যাবতীয় দায় পরিশোধ হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।

তবে শর্ত থাকে যে, যে ব্যক্তিকে এই ধারার অধীনে আমানতের টাকা পরিশোধ করা হইয়াছে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্য কোন ব্যক্তির কোন অধিকার বা দাবী থাকিলে তাহা এই উপ-ধারার বিধান ক্ষুন্ন করিবে না৷

আইনের উপরোক্ত বিধানানুযায়ী এটা পরিষ্কার যে, কোন একাউন্টধারীর মৃত্যুর পর তার মনোনীত ব্যক্তিই উক্ত টাকা পাবেন উত্তরাধিকারী নয়।
 

কিন্তু শরিয়াত এ্যাপ্লিকেশান এ্যাক্ট ১৯৩৭ এর ২ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মুসলমানদের জন্য উত্তরাধিকার বন্টনের ক্ষেত্রে মুসলিম শরিয়া আইন প্রযোজ্য হবে। আমরা জানি যে,  কোন মমুসলমান মারা গেলে এবং মুসলিম শরিয়া মোতাবেক মৃত ব্যক্তির পর্যাপ্ত সম্পত্তি থাকলে সেখান থেকে তার দাফন কাফনের যাবতীয় খরচ মেটাতে হবে। তিনি যদি জীবিত থাকা অবস্থায় কোন ধার-দেনা করে থাকেন তবে তাও রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে পরিশোধ করে দিতে হবে। তার স্ত্রী বা স্ত্রীদের দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকলে বা আংশিক অপরিশোধিত থাকলে তা পরিশোধ করে দিতে হবে। মোট কথা স্ত্রীর সম্পূর্ণ দেনমোহর স্বামী মৃত অথবা জীবিত যাই থাকুক না কেন তা স্বামীর সম্পত্তি থেকে আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণ পরিশোধ করে দিতে হবে। মৃত ব্যক্তি কোন দান কিংবা উইল করে গেলে তা প্রাপককে দিয়ে দিতে হবে। বর্ণিত সব কাজ সম্পন্ন করার পরে মৃত ব্যক্তির অবশিষ্ট সম্পত্তি ফারায়েজ আইন অনুযায়ী তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, মুসলিম আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ব্যাংকের টাকা তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে মুসলিম ফারায়েজ অনুযায়ী বন্টিত হবে। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত)-এর ১০৩ ধারা এবং শরিয়াত এ্যাপ্লিকেশান এ্যাক্ট ১৯৩৭ এর ২ ধারা দুই রকম কথা বলছে অর্থাৎ আইন দুটির মধ্যে স্পষ্ট দ্বন্দ্ব বিরাজমান। এখন প্রশ্ন দাড়াচ্ছে তাহলে কোন আইনের বিধান এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। দুটি আইনই বিশেষ আইন। দুটি আইনের মর্যাদা একই। তাহলে মীমাংসা কিভাবে হবে?

চিন্তার কিছু নেই। আমাদের জেনারেল ক্লজেজ এ্যাক্ট ১৮৯৭ এই সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। এই আইনের বিধান মতে, যে স্পেশাল আইনটি সর্বশেষ পাশ হয়েছে সেই আইনটি প্রয়োগ করা হবে। এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকিং কোম্পনিজ আইন, ১৯৯১ আইনটি সর্বশেষ পাশ হয়েছে তাই এই আইনটিই প্রয়োগ করা হবে। অর্থাৎ মহামান্য আপীল বিভাগের চূড়ান্ত রায় না আসা পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া ব্যাংক আমানত তার মনোনীত ব্যক্তিই পাবেন। উত্তরাধিকারীরা উক্ত টাকা পাওনা থেকে বঞ্চিত হবেন।

আপনি কি আমাদের ব্লগে লিখতে আগ্রহী? তাহলে এখানে নিবন্ধন করুন।
আপনার কি কিছু বলার ছিল? তাহলে লিখুন নিচে মন্তব্যের ঘরে।

১টি মন্তব্য

  1. লেখক কে ধন্যবাদ। এত সুন্দর একটি পোস্ট করার জন্য। আসলেই পোস্টটি অনেক তথ্যবহুল। মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া টাকা কে পাবে, নমিনি নাকি উত্তরাধিকারী এই নিয়ে অনেক দ্বিধাদ্বন্দে ছিলাম। এখন বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। আবারো লেখককে ধন্যবাদ।
Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.