Search Suggest

দন্ডবিধির ৪৯৭ ধারা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি

পৃথিবীর সকল দেশের মত আমাদের দেশের সংবিধানেও কিছু মৌলিক অধিকার বিষয়ক অনুচ্ছেদ অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রাষ্ট্র কোনভাবেই এই অধিকার অস্বীকার বা লঙ্ঘন করতে পারে না। জনগণের এই মৌলিক অধিকার যাতে লঙ্ঘিত না হয় বা অস্বীকৃত না হয়, সে বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সংবিধান আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের উপর অর্পন করেছে। সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বা সংবিধান পরিপন্থি যেকোন আইন, কাজ, নীতি বা পদক্ষেপ বাতিল বলে গণ্য হয়। কারণ সংবিধান হলো রাষ্ট্রের প্রধান আইন বা সুপ্রিম ল। সংবিধানের উপর ভিত্তি করেই দেশের যাবতীয় কার্যাবলী পরিচালিত হয়।

সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হলো জনগণের মৌলিক অধিকারের অধ্যায়। যদিও বেশ কিছু মৌলিক অধিকারের বিষয়ে আমাদের সংবিধানে উল্লেখ করা আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে প্রচারিত এবং সবচেয়ে আলোচিত একটি মৌলিক অধিকার হলো ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। এই মৌলিক অধিকারটি সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে স্থান পেয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়- আইনের চোখ হলো অন্ধ অর্থ্যাৎ আইন নারী, পুরুষ, ধনী,গরীব, বড়লোক, ছোটলোক কিচ্ছু দেখেনা। আইনের চোখে উচু নিচু বলে কিছু নেই। আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ হতে হবে। সংবিধানে বিবৃত অন্য মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জ্ঞান না থাকলেও একজন গরীব দিন মজুরও জানেন যে, আইন সবার জন্য সমান। দেশের প্রধানমন্ত্রি অপরাধ করলেও যে শাস্তির বিধান রয়েছে, একজন গরীব কৃষক অপরাধ করলেও সেই একই শাস্তির বিধান রয়েছে।

উক্ত মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি আমাদের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে আরেকটি মৌলিক অধিকারের বিষয়ে বলা হয়েছে। সেটি হলো- ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে।’ এখানে অন্যান্য বৈষম্যের পাশাপাশি এখানে লিঙ্গ বৈষম্যের বিষয়েও বলা হয়েছে। নারী-পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ করা যাবেনা। নারী ও পুরুষকে সমান চোখে দেখতে হবে। আইন প্রণেতাগণ যখন আইন প্রণয়ন করেন তখন তাদেরকে সংবিধানের এই মৌলিক অধিকারের বিষয়ে সচেতন থেকেই আইন প্রণয়ন করতে হয়। কারণ সংবিধানের পরিপন্থি যেকোন আইনই বাতিল বলে গণ্য।

সব ধর্মের ব্যক্তিগত আইনগুলোর পাশাপাশি আমাদের দন্ডবিধি ১৮৬০ এর মধ্যেও বিবাহবন্ধনের পবিত্রতা রক্ষার্থের কথা বলা আছে। দন্ডবিধি ১৮৬০ এর বিশতম অধ্যায় অর্থাৎ ধারা ৪৯৩ থেকে ৪৯৮ পর্যন্ত বিবাহ বিষয়ক অপরাধ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়েরই একটি উল্লেখযোগ্য ধারা ৪৯৭, যেখানে ব্যভিচারের ব্যাপারে বলা হয়েছে। এই ধারাটি আসলে লিঙ্গ বৈষম্যের সামিল। এই ধারায় যেহেতু লিঙ্গ বৈষম্য সুস্পষ্ট, কাজেই ধারাটি আমাদের সর্বোচ্চ আইন অর্থাৎ সংবিধানে উল্লেখিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। দন্ডবিধি ১৮৬০ এর  ৪৯৭ ধারায় বলা হয়েছে যে,
”whoever has sexual intercourse with a person who is and whom he knows or has reason to believe to be the wife of another man, without the consent or connivance of that man, such sexual intercourse not amounting to the offence of rape, is guilty of the offence of adultery, and shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to five years, or with fine, or with both. In such case the wife shall not be punishable as an abettor.” অর্থাৎ 'যদি কোনো ব্যক্তি এমন কোনো নারীর সঙ্গে তার স্বামীর সম্মতি ছাড়া যৌনসঙ্গম করে এবং অনুরূপ যৌনসঙ্গম যদি ধর্ষণের অপরাধ না হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবে, যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদন্ডসহ উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। তবে, এরকম ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকটি দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী হিসেবে শাস্তিযোগ্য হবে না।’

উপরোক্ত ধারা থেকে বোঝা যায় যে, ধর্ষণ না করে অর্থাৎ কোনো বিবাহিত স্ত্রী লোকের সম্মতি নিয়ে তার স্বামীর সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ব্যভিচার এবং এর শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছর বা জরিমানা বা উভয় দন্ড। কিন্তু এই সাজা কেবল পুরুষের জন্য, নারীর জন্য নয়। যেহেতু এই ধারার অপরাধটি ধর্ষণ নয় সুতরাং বোঝা যাচ্ছে এখানে নারীর সম্মতি ছিল। উল্লেখিত ধারা অনুযায়ী ব্যভিচার হতে হলে নিম্নোক্ত উপাদানগুলি থাকতে হবে-

১। যৌন সঙ্গমের উপস্থিতি;
২। একজন পুরুষ ও একজন বিবাহিতা নারী;
৩। যে পুরুষ যৌন সঙ্গম করবেন তিনি যুক্তিসঙ্গতভাবে বিশ্বাস করবেন যে তার যৌন সঙ্গমের সঙ্গি মহিলা অন্য পুরুষের বিবাহিতা স্ত্রী;
৪। বিবাহটি বৈধ বিবাহ ছিল;
৫। বিবাহিতা মহিলার সম্মতি ছিল;
৬। বিবাহিতা মহিলার স্বামীর সম্মতি ছিল না;

উপরোক্ত উপাদানগুলি থাকলে পুরুষটি ৪৯৭ ধারার অপরাধে দন্ডিত হবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে নারীকে কোন দোষ দেওয়া যাবেনা। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যে, নারীর সম্মতি ছাড়া ব্যভিচার কখনোই সম্ভব নয়। তারপরও নারীকে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। উভয়ে অপরাধ করলেও শুধুমাত্র পুরুষকেই বিচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। যেহেতু ব্যভিচার একটি অপরাধ। আর উক্ত অপরাধে নারী পুরুষ উভয়েই জড়িত। বিধায় নারী পুরুষ উভয়ের শাস্তির বিধান না রেখে অযৌক্তিকভাবে শুধুমাত্র পুরুষের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে যেটি কে আমরা লিঙ্গ বৈষম্য বলতে পারি এবং আইনের চোখে সকলেই সমান এই মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। কোন অপরাধ করার ক্ষেত্রে মূল অপরাধীকে সাহায্য করাও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত এবং বিভিন্ন অপরাধের প্ররোচণার জন্য ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির বিধান রয়েছে বিভিন্ন ধারাতে। তাহলে সব অপরাধের ক্ষেত্রে যেখানে অপরাধী এবং প্ররোচণাদাতা উভয়কে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, সেখানে ব্যভিচারের ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম কেন? এভাবে ব্যভিচারিনীকে ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে নারীদেরকে ব্যভিচারে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। আমরা এটা ভাবতে পারি যে, পুরুষরা নারীকে প্রলোভিত করে নারীর সহিত সঙ্গম করে। এজন্যই নারীদেরকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে, নারীই পুরুষকে প্রলোভন দেখিয়ে সঙ্গমে রাজী করিয়েছে! বা এমনটিও হতে পারে যে, নারীই হলো মুল অপরাধকারী আর পুরুষ হলো উক্ত অপরাধে সহায়তাকারী!

শুধুমাত্র এই বৈষম্যই নয়। এই ধারা কতটা বিতর্কিত তা ধারাটি একটু ভাল করে পড়লেই স্পষ্ট হয়। এই ধারায় বলা হয়েছে যে, বিবাহিতা নারীর স্বামীর সম্মতি ব্যতিরেকে কোন পুরুষ ঐ নারীর সহিত সঙ্গম করলে তা ব্যভিচার হবে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় যে, ঐ নারাীর স্বামী সম্মতি দিলে সেটা কি কোন অপরাধ হবে না? ব্যভিচার হওয়া বা না হওয়া কি স্বামীর সম্মতি বা অসম্মতির ব্যাপার? নারীর সম্মতির কি কোন মূল্যই নেই?

এছাড়া ব্যভিচার করলে ব্যভিচারিনী নারীর স্বামী উক্ত পুরুষের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দাযের করতে পারে। এই অধিকার ব্যভিচারিনী নারীর স্বামীকে দেওয়া হলো। কারণ তার সম্মতি ছাড়া ঐ ব্যক্তি ব্যভিচার করেছে। তাহলে যে পুরুষ ব্যভিচার করলো, সেও তো তার নিজের স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া ব্যভিচার করেছে। তাহলে ঐ ব্যভিচারী পুরুষের স্ত্রী কেন ব্যভিচারিনী নারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না? কেন সে মামলা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে? ব্যভিচারে প্রলুব্ধকারী যদি নারীই হয় তাহলে ব্যভিচারে অংশ নেওয়া ‍পুরুষের স্ত্রী কেন ব্যভিচারে প্রলুব্ধকারী নারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে না?

এই ধারাটি ধর্মীয় আইনেরও পরিপন্থি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে,

 “ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারীদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত কর, আল্লাহর বিধান কার্যকরী করতে ওদের প্রতি দয়া যেন তোমমাদেরকে অভিভূত না করে- যদি তোমরা আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাসী হও। আর মু’মিনদের একটি দল যেন ওদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।” (সূরা নূর ২ আয়াত)।

এ ছাড়া মহানবী (স:) এর জবানী মতে উভয়কে বেত্রাঘাতসহ একবছরের জন্য দেশ থেকে বহিষ্কার করার কথাও বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ইসলাম ধর্মে ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ উভয়ের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নারী পুরুষে ভেদাভেদ রাখা হয়নি।

সার্বিক দিক বিবেচনা করে দন্ডবিধির বিতর্কিত ৪৯৭ ধারাটি অতিসত্বর সংশোধন করা উচিত। যেখানে নারী ও পুরুষকে আমাদের সংবিধান সমান অধিকার দিয়েছে সেখানে আমরা একই অপরাধের জন্য পুরুষকে শাস্তি দিচ্ছি অথচ নারীকে সরাসরি দায়মুক্ত করছি। এতে নারীরা পরোক্ষভাবে ব্যভিচারে উৎসাহিত হবে। ব্যভিচার রোধে বিদ্যমান আইন টি সংশোধন করে ব্যভিচারের শাস্তি নারী পুরুষ উভয়ের সমান করা উচিত। আরেকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। তাহলো, ১৮৬০ সালে যখন আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল তখনকার পরিস্থিতি বর্তমান পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। তখনকার সমাজ সংস্কৃতি আর বর্তমান সমাজ সংস্কৃতি এক নয়। তখনকার নারীর অবস্থা আর বর্তমান নারীদের অবস্থার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য বিদ্যমান। তাই মান্ধাত্বার আমলের ঐ আইন বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে সংশোধন করা জরুরী।

আপনি কি আমাদের ব্লগে লিখতে আগ্রহী? তাহলে এখানে নিবন্ধন করুন।
আপনার কি কিছু বলার ছিল? তাহলে লিখুন নিচে মন্তব্যের ঘরে।

"বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র; নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবা রাত্র।”আমি কোন পন্ডিত নই। আমি ছাত্র। জ্ঞান পিপাসায় আমি কাতর। তবে যতটুকু জানি ততটুকু সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার লেখা পড়ার পর যদি সময় পান তাহলে নিচে মন্তব্যের ঘরে আপনার একটি গঠনমূলক মন্তব্য করে যাবেন এই আশা রাখি আপনার কাছ থেকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন