Search Suggest

ফ্ল্যাট ক্রয় সংক্রান্ত সমস্যার আইনি সমাধান

সাধ্যের মধ্যে নিজের একটি বাড়ির সাধ কার না থাকে। কিন্তু ইট-কাঠের এই শহরে বাড়ি তৈরি করা বা কেনা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। বাড়ির জন্য যেমন চাই জমি, আবার জমি থাকলেই বাড়ি হয় না। তাই যাঁদের জমি নেই, তাঁদের জন্য সমাধান তৈরি ফ্ল্যাট; আর যাঁরা জমি থাকতেও বাড়ি করতে পারছেন না, তাঁদের মুশকিলের আসানকারী যেন ডেভেলপার। কিন্তু সাধ ও সাধ্যের মিলনে এখানেও বাধা।


অভিযোগ আছে, চুক্তি করার আগে ডেভেলপাররা ভূমির মালিককে রীতিমতো তেল মর্দন করলেও চুক্তির পর তার চিত্র ঠিক উল্টো। আবার ফ্রি অফার, নির্দিষ্ট সময়ে হস্তান্তর, অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা—নানা ছলাকলার ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই জলের মধ্যে টাকা ফেলেন, অথচ বছরের পর বছর পার হলেও সেই জলও শোকায় না, ফ্ল্যাটেরও দেখা মেলে না। আশা তখন হতাশায় পরিণত হয়। তাই চুক্তি করার আগে কিংবা ফ্ল্যাট বা প্লট বুকিং দেওয়ার আগে কিছু বিষয় সবারই জানা দরকার। সমস্যা সমাধানকল্পে ২০১০ সালে প্রণীত রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইনেই এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।

রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার নিবন্ধন ও তার দায়দায়িত্ব
ডেভেলপারের হাতে জমি তুলে দেওয়ার আগে আপনাকে জেনে নিতে হবে ডেভেলপার কোম্পানিটি নিবন্ধিত কি না। আইন অনুযায়ী কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় ব্যবসা করার জন্য রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারকে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এবং সারা দেশে ব্যবসা করার জন্য সরকারের কাছ থেকে নিবন্ধন গ্রহণ করতে হবে। এই নিবন্ধন পাঁচ বছর পর পর নবায়নযোগ্য। নিবন্ধিত ডেভেলপারদের তালিকা যদি কর্তৃপক্ষের কাছে সংরক্ষিত থাকে সেখান থেকেই আপনি জেনে নিতে পারবেন। ডেভেলপারকে তাদের প্রসপেক্টাসে রিয়েল এস্টেটের নিবন্ধন নম্বরসহ নাম-ঠিকানা ও যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত নকশার নম্বরসহ স্মারক নম্বর ও তারিখ উল্লেখ করতে হবে। কোনো ডেভেলপারই প্রকল্প অনুমোদনের আগে প্রকল্পের বিজ্ঞপ্তি প্রচার করতে পারবে না এবং ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো চুক্তি করতে পারবে না। প্লট কেনার আগে অবশ্যই আপনি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও জমির মালিকানাসংক্রান্ত কাগজপত্র দেখে নেবেন এবং ডেভেলপার তা আপনাকে দেখাতে বাধ্য। প্রকল্পগুলো এমনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে করে অবকাঠামোগত যেমন: রাস্তাঘাট, বৈদ্যুতিক সংযোগ, পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, গ্যাস সংযোগ, টেলিফোন সংযোগ বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সুবিধার কোনো ক্ষতি সাধন না হয়। কোনো ব্যক্তি নিবন্ধন ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করলে বা কোনো ডেভেলপার অনুমোদন ছাড়া প্রকল্পের কাজ শুরু করলে বা বিজ্ঞাপন প্রচার করলে দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকার অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

মালিক ও ডেভেলপারের মধ্যে চুক্তি 
রিয়েল এস্টেট উন্নয়নের লক্ষ্যে জমি হস্তান্তরের আগে মালিক ও ডেভেলপারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন করতে হয়। চুক্তিতে কে কত অংশ পাবে তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকতে হবে অর্থাৎ রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন বাবদ ডেভেলপারের পাওয়া অংশ ও জমির মালিকের অংশের পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। এ ছাড়া ডেভেলপারের পাওয়া অংশ ক্রেতা বরাবর দলিল সম্পাদন ও হস্তান্তরের ক্ষমতা প্রদানের উদ্দেশ্যে ডেভেলপার বরাবর আমমোক্তারনামা দলিল সম্পাদনসহ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু ও শেষ করার তারিখ উল্লেখ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভূমির মালিকের অংশ হস্তান্তর না করলে বা দখল বুঝিয়ে না দিলে ডেভেলপারের দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা ২০ লাখ টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। আবার ভূমির মালিক যদি চুক্তিতে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে ডেভেলপারের কাছে জমির দখল হস্তান্তর না করে বা ডেভেলপার বরাবর সম্পাদিত আমমোক্তারনামা কোনো নোটিশ ছাড়াই বাতিল করে তবে সেও দণ্ডিত হবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রত্যেক ডেভেলপারকে রিয়েল এস্টেট হস্তান্তরের পর কমপক্ষে এক বছর পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে এবং নির্মাণসংক্রান্ত ত্রুটির কারণে মেরামতের প্রয়োজন হলে দুই বছর পর্যন্ত ডেভেলপার নিজ খরচে তা মেরামত করবে। হস্তান্তরের আগে অবশ্যই সব ধরনের ইউটিলিটি সার্ভিস যেমন: পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, অগ্নিনিরোধক-ব্যবস্থা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে।

রিয়েল এস্টেট ক্রয়-বিক্রয়, রেজিস্ট্রেশন, হস্তান্তর 
আপনাকে ফ্ল্যাট কিনতে হলে ডেভেলপারের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে এবং এ চুক্তিতে ক্রয়-বিক্রয়সংক্রান্ত বিস্তারিত শর্ত উল্লেখ থাকবে। চুক্তি বা বরাদ্দপত্রে ভবনে অবশ্যই যেসব ফিটিংস-ফিক্সার ইত্যাদি ব্যবহার করা হবে তার বিবরণ থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে কাঠামো নকশা যোগ্যতাসম্পন্ন লোক দ্বারা প্রণয়ন করা হয়েছে কি না, এবং প্রণয়নের সময় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হয়েছে কি না, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। প্রণীত অনুমোদিত নকশা ডেভেলপার আপনাকে দিতে বাধ্য থাকবে। চুক্তির ভিত্তিতে ডেভেলপার আপনাকে পছন্দসই ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেবে এবং আপনার বিনা অনুমতিতে বরাদ্দ করা প্লট বা ফ্ল্যাট পরিবর্তন করতে পারবে না। চুক্তিতে উল্লিখিত শর্তের বাইরে অতিরিক্ত কোনো অর্থ দিতে আপনি বাধ্য নন, তবে যদি কোনো উন্নতমানের সরঞ্জাম সংযোজনের দরকার হয়, তবে দুই পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিতে অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া যেতে পারে। সমুদয় মূল্য পরিশোধের তিন মাসের মধ্যে ডেভেলপার আপনাকে দখল হস্তান্তর, দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রেশনের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করে দেবে এবং হস্তান্তরকালে আয়তন কম-বেশি হলে তার মূল্য ক্রয়মূল্য অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। আপনাকে রিয়েল এস্টেটের মূল্য ব্যাংকের মাধ্যমে এককালীন বা কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। আপনি এককালীন বা কিস্তিতে মূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হলে ডেভেলপার ৬০ দিনের আগে নোটিশ দিয়ে বরাদ্দ বাতিল করতে পারবে এবং এ ক্ষেত্রে ডেভেলপার আপনার জমা করা অর্থ পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে চেকের মাধ্যমে একসঙ্গে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। তবে আপনি বিলম্বিত সময়ের জন্য কিস্তির অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে সুদ প্রদানসহকারে কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন তবে তা তিনবারের বেশি করতে পারবেন না। আবার ডেভেলপার নির্দিষ্ট সময়ে ফ্ল্যাট হস্তান্তরে ব্যর্থ হলে চুক্তিতে নির্ধারিত ক্ষতিপূরণসহ সব অর্থ আপনাকে ছয় মাসের মধ্যে ফেরত দেবে, তবে চুক্তিতে ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ না থাকলে তা পরিশোধিত অর্থের ওপর ১৫ শতাংশ হারে নির্ধারিত হবে। আবার আপনি কোনো কারণে বরাদ্দ বাতিল করতে চাইলে ডেভেলপার আপনার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিশোধিত অর্থের ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে বাকি অর্থ তিন মাসের মধ্যে এককালীন চেক বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে ফেরত দেবে।

বিরোধ ও বিচারপদ্ধতি
এই আইনের অধীন অপরাধগুলো আপসযোগ্য, জামিনযোগ্য ও অ-আমলযোগ্য এবং প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য। বিচারের সময় ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার করা হবে। তবে সম্পাদিত চুক্তির কোনো বিধান যেমন: নোটিশ ছাড়া বরাদ্দ বাতিল, প্রতিশ্রুত নির্মাণ উপকরণ ব্যবহার না করা, অননুমোদিত নকশাবহির্ভূত নির্মাণ, অনুমতি ছাড়া রিয়েল এস্টেট বন্ধক রাখা ইত্যাদি লঙ্ঘনের জন্য মতবিরোধ দেখা দিলে পক্ষদয় প্রথমে নিজেদের মধ্যে আপসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করবে এবং কোনো কারণে তা ব্যর্থ হলে বিষয়টি সালিস আইন-২০০১ মোতাবেক সালিসি ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হবে এবং ৩০ দিনের মধ্যে পক্ষগণ ট্রাইব্যুনাল গঠনে ব্যর্থ হলে যেকোনো পক্ষ বিবদমান বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। সব শেষে সাধ ও সাধ্য যখন একই বিন্দুতে মিলিত হয়, তখনই কেবল কাঙ্ক্ষিত সুখের নাগাল মেলে। তাই সাধ্যের মধ্যে বাড়ি তৈরি বা ফ্ল্যাট কিনে সবটুকু সুখ পেতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি ডেভেলপার কোম্পানিগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে তাদের কাজগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করার। তাই উভয় পক্ষের সচেতনতা ও দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়ে যাতে মালিক বা ক্রেতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়, সেই চেষ্টা করতে হবে।

তথ্যসুত্রঃ বাংলাদেশের আইন কানুন


সুপ্রিয় লিখিয়ে পাঠক! আপনি জেনে নিশ্চয় আনন্দিত হবেন যে, আইন সচেতন সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সচেতন নাগরিক হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আমাদের এই উদ্যোগ। চাইলে আপনিও হতে পারেন এই গৌরবের একজন গর্বিত অংশীদার। আমাদের ব্লগে নিবন্ধন করে আপনিও হতে পারেন আমাদের সম্মানিত লেখক। লিখতে পারেন আইন-আদালত, পরিবেশ, ইসলামী আইন যেমন কোরআন, হাদিসের আইনগত বিষয়, প্রাকৃতিক আইন, বিভিন্ন অপরাধ সম্পর্কিত প্রতিবেদন বা অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি, অন্যায়, দূর্নীতি, হয়রানী, ইভটিজিং, বেআইনী ফতোয়া, বাল্য বিবাহ ইত্যাদিসহ যাবতীয় আইনগত বিষয়াবলী নিয়ে। আমাদের ব্লগের সদস্য হোন আর হারিয়ে যান জ্ঞান বিকাশের এক উন্মুক্ত দুনিয়ায়!

আপনি কি আমাদের ব্লগে লিখতে আগ্রহী? তাহলে এখানে নিবন্ধন করুন। আপনার কি কিছু বলার ছিল? তাহলে লিখুন নিচে মন্তব্যের ঘরে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন