বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে ডিভোর্সের হার যেভাবে বেড়েছে, তা কেবল আইনের সংখ্যাতত্ত্ব নয়, বরং সমাজের গতিধারা ও ব্যক্তিগত দাম্পত্য সম্পর্কের জটিলতার প্রতিফলন। আইনত ৯০ দিনের মীমাংসার সুযোগ থাকলেও, বাস্তবে এই সময়কালে দম্পতিদের সামনে আসে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ - সংস্কৃতির বাঁধন, ব্যক্তিগত আশঙ্কা, এবং পর্যাপ্ত সাহায্যের অভাব।
মীমাংসার সময়কাল:
বাংলাদেশের ডিভোর্স আইনের কেন্দ্রে রয়েছে ৯০ দিনের মীমাংসার সময়কাল। এই গুরুত্বপূর্ণ সময় দম্পতিদের ঝামেলা মিটিয়ে সংসার পুনর্নির্মাণের সুযোগ দেয়। এই সময়ে:
- নোটিশ ও ইচ্ছা: ডিভোর্স চাইলে স্বামী (তালাকের ক্ষেত্রে) বা স্ত্রী (খুলা ক্ষেত্রে) অন্য পক্ষকে এবং ইউনিয়ন কাউন্সিল বা মেয়র অফিসের মতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেন।
- সাহায্যের সন্ধান: সাধারণত পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সমাজের নেতারা এই সময়ে মীমাংসা আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে, পেশাদার পরামর্শের প্রয়োজনীয়তাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- আনুষ্ঠানিক পথ: অপ্রাতিষ্ঠানিক মধ্যস্থতা প্রচলিত থাকলেও, দম্পতিরা ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যান বা সিটি কর্পোরেশন মেয়রের মতো নির্দিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছেও সাহায্য নিতে পারেন।
চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা:
মীমাংসার উদ্দেশ্য ভালো হলেও, কয়েকটি চ্যালেঞ্জ এর কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করে:
- সামাজিক কুসংস্কার: দাম্পত্য সমস্যায় পেশাদার সাহায্য নেওয়া, বিশেষ করে পুরুষদের জন্য, অনেক সময় সমাজের কুচোখের শিকার হয়। এটি দম্পতিদের কাউন্সেলিংয়ের মতো সম্ভাবনাময় পথ এড়িয়ে যেতে বাধ্য করে।
- সীমিত সম্পদ: মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং দাম্পত্য কাউন্সেলরদের সংখ্যা, বিশেষ করে শহরের বাইরে, কম। ফলে, দাম্পত্য সমস্যায় থাকা দম্পতিদের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্যের অভাব।
- অমীমাংসিত ইস্যু: ৯০ দিনের সময়কাল কখনোই দাম্পত্য বিচ্ছেদের মূল কারণগুলো সমাধানের জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে, ফলে তাড়াহুড়ো করে বা অসম্পূর্ণ মীমাংসার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
নতুন আশা ও সম্ভাবনা:
চ্যালেঞ্জ থাকলেও, কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে:
- বর্ধমান সচেতনতা: দাম্পত্য সমস্যায় পেশাদার সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ স্বীকৃত হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য ও কাউন্সেলিং সেবার প্রচার ও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে উদ্যোগ বাড়ছে।
- ব্যক্তিগত উদ্যোগ: বেসরকারি কাউন্সেলিং কেন্দ্র ও অনলাইন প্লাটফর্ম গোপনীয় ও সহজলভ্য উপায়ে দম্পতিদের পরামর্শ ও সমাধান দিচ্ছে।
- আইনি সংস্কার: সাম্প্রতিক আইন সংশোধন মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও মীমাংসা প্রক্রিয়ায় তাদের অধিকার সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে।
আগামীর পথ:
বাংলাদেশে ডিভোর্স হার কমানোর জন্য বহুমুখী কৌশল প্রয়োজন:
- মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব: দাম্পত্য সমস্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা পেশাদার সাহায্য নিতে উৎসাহিত করতে পারে।
- সাহায্যের প্রসারিতকরণ: বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং দাম্পত্য কাউন্সেলরদের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
- সম্পূর্ণ সমাধান: আইনি সংস্কার এবং সহজলভ্য সাহায্যের পাশাপাশি, দাম্পত্য বিচ্ছেদের কারণ খুঁজে বের করে-সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে।
বাংলাদেশে ডিভোর্সের জটিলতার স্বীকৃতি, খোলাখুলি আলোচনা, এবং সহজলভ্য সাহায্যের ব্যবস্থাপনা- এই তিনটি উপাদানের মাধ্যমে আমরা সুস্থ দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি এবং দাম্পত্য জাহাজের ঝড় মোকাবেলে এগিয়ে যেতে পারি।
মনে রাখবেন, সাহায্য চাওয়া দুর্বলতা নয়, শক্তির পরিচয়। আপনি বা আপনার কাছের কেউ যদি দাম্পত্য সমস্যায় ভুগছেন, পেশাদার পরামর্শ নিতে দ্বিধা করবেন না। একসঙ্গে আমরা সবাই মিলে সবার জন্য আরও সহনশীল ও সমর্থনময় সমাজ গড়ে তুলতে পারি।