Search Suggest

রেজিস্ট্রেশন ফি গোপনের অভিযোগে নিলাম ক্রয়কারীদের হয়রানি: দুদকের এখতিয়ার কতটুক?

নিলাম ক্রয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রেজিস্ট্রেশন ফি গোপন সম্পত্তি মালিকানা আদালতের রায় ক্ষমতার অপব্যবহার হয়রানি আইনগত পদ্ধতি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত

 


নিলাম ক্রয়কৃত সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের হস্তক্ষেপ বৈধ কিনা?

বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের একটি রায়ে নিলামের মাধ্যমে ক্রয়কৃত একটি সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হস্তক্ষেপকে বৈধতা প্রদানের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এই মামলাটি সম্পত্তি বিরোধ এবং দুদকের ক্ষমতার সীমারেক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে।

মামলার বিবরণ অনুযায়ী, কিছু ব্যক্তি আদালতের নির্দেশে নিলামের মাধ্যমে একটি জমি ক্রয় করেন। আদালত তাদের এই জমির দখলদারও ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে, এই ক্রয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রিট পিটিশন এবং লিভ পিটিশন দায়ের করা হয়, কিন্তু সবগুলোই খারিজ করা হয়। এই নিলাম ক্রয়কারীরা তাদের রেজিস্ট্রেশন করতে না পারলে রাজউকের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দায়ের করেন এবং হাইকোর্ট তাদের পক্ষে রায় দেন।

অপ্রত্যাশিতভাবে, দুদক ক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্রেশন ফি গোপনের অভিযোগে নোটিশ জারি করে। ক্রয়কারীরা হাইকোর্টে এই নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন।

হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, যখন কোনো আইনগত বিষয় সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়, তারপর সরকারি কর্তৃপত্ত্ব বা দুদকের মতো আইনগত সংস্থা আদালতের পূর্ব অনুমোদন ছাড়াই সেই একই বিষয় পুনরায় খুলতে পারে না। এমন ক্ষেত্রে এই ধরনের উদ্যোগ হবে সম্পূর্ণরূপে কুমতলবী এবং ক্ষমতার অপব্যবহার।

উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ আরও বলছে যে দুদক আইন দ্বারা যেকোনো অভিযোগ তদন্ত করতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত, তবে অবশ্যই এটি সৎ উদ্দেশ্যে এবং আইনসম্মতভাবে করতে হবে। নোটিশ জারি করার আগে দুদককে যথাযথ তদন্ত ও প্রাথমিক পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

এই মামলায়, হাইকোর্ট মনে করেন যে ক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপ্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত তারা রেজিস্ট্রেশন ফি গোপন করেছেন বলে মনে করা যায় না। এছাড়াও, রেজিস্ট্রেশন ফি গোপন দুদক আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়ে না। অতএব, দুদকের নোটিশগুলো কুমতলব দ্বারা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে জারি করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।

বিচার বিভাগের চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর পুনরায় তদন্ত কী অবৈধ ক্ষমতার অপব্যবহার?

এই মামলায় উচ্চ আদালত মত প্রকাশ করেছে যে, যখন কোনো আইনগত বিষয় সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়ে যায়, তারপর কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সেই একই বিষয় পুনরায় খুলতে পারে না। এমন ক্ষেত্রে পুনরায় তদন্ত বা হস্তক্ষেপ করা হলে তা অবৈধ ক্ষমতার অপব্যবহার বলে বিবেচিত হবে।

এই মামলায়, নিলাম ক্রয়কৃত সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে সকল আইনগত লড়াই সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গিয়েছিল এবং ক্রয়কারীদের পক্ষে রায় হয়েছিল। অতএব, দুদকের এই বিষয়ে পুনরায় তদন্ত শুরু করা হাইকোর্টের মতে ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই রায়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করে এবং কোনো ব্যক্তিকে একই অভিযোগে একাধিকবার হয়রানি থেকে রক্ষা করে। এই রায়টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে মনে করিয়ে দেয় যে তারা অবশ্যই আইন অনুসারে কাজ করবে এবং আদালতের সিদ্ধান্তকে সম্মান করবে।

রেজিস্ট্রেশন ফি গোপনের অভিযোগ কি দুর্নীতি দমন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত?

এই মামলায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে এসেছে, রেজিস্ট্রেশন ফি গোপন কি দুদক আইনের আওতাভুক্ত অপরাধ? হাইকোর্টের মতে, রেজিস্ট্রেশন ফি গোপন দুদক আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়ে না। দুদক আইন কেবলমাত্র নির্দিষ্ট কিছু অপরাধ তদন্ত করার ক্ষমতা রাখে, এবং রেজিস্ট্রেশন ফি গোপন এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নেই।

অতএব, দুদকের এই মামলাটি আইনতভাবেই দুর্বল। ক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্রেশন ফি গোপনের অভিযোগ আছে বলে মনে করা হলেও, দুদকের এই অভিযোগ তদন্ত করার কোনো ক্ষমতা নেই। এক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন অধিদফতর বা অন্য কোনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই এই অভিযোগ তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ কি মৌলিক সম্পত্তি অধিকার লঙ্ঘন?

এই মামলাটি বাংলাদেশের সংবিধানে নিশ্চিত সম্পত্তির মৌলিক অধিকারের দিকটিও সামনে নিয়ে আসে। ক্রয়কারীরা ঠিকভাবে সম্পত্তি ক্রয় করেছেন এবং আদালত তাদের মালিকানা স্বীকার করেছেন। দুদকের হঠাৎ হস্তক্ষেপ ও নোটিশ ইস্যু করা ক্রয়কারীদের এই মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাবনা তৈরি করে।

হাইকোর্ট মনে করেন যে আদালতের চূড়ান্ত রায়ের পর দুদকের এই ধরনের হস্তক্ষেপ ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়ায় অনিয়ম প্রকাশ করার সমান। এটি ক্রয়কারীদের মালিকানা উপভোগের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে এবং তাদের মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

ক্রয়কারীরা ইতিমধ্যে আদালতের কাছে তাদের মালিকানা প্রমাণ করেছেন, অতএব দুদকের পুনরায় তদন্ত বা হস্তক্ষেপ তাদের আইনগত অধিকারে হস্তক্ষেপ এবং আইনের নিশ্চয়তা লঙ্ঘন। এই মামলা বিচার বিভাগ ও দুদকের মধ্যে ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রাথমিক তদন্ত ছাড়া নোটিশ দেয়া কি আইনগত পদ্ধতি লঙ্ঘন?

দুদকের নোটিশগুলো আইনগত পদ্ধতি অনুসরণ করে জারি করা হয়েছে কিনা, সে বিষয়েও হাইকোর্ট প্রশ্ন উঠিয়েছে। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়, দুদক ক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে কোনো পূর্ব-তদন্ত ছাড়াই হঠাৎ করে নোটিশ জারি করেছে। এর ফলে ক্রয়কারীদের নিজেদের পক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করার সুযোগ deprived হয়েছে।

দুদক আইন ও দুদক নীতিমালা অনুসারে, কোনো অভিযোগ তদন্ত শুরু করার আগে দুদকের একটি স্ক্রুটিনি কমিটি মাধ্যমে অভিযোগের প্রাথমিক যথার্থতা নিশ্চিত করা উচিত। কিন্তু এই মামলায় দুদক এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি। ফলে আদালতের মতে, নোটিশগুলো অবৈধ ও আইনগত পদ্ধতি লঙ্ঘন করে জারি করা হয়েছে।

খারাপ উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার কি আদালতের হস্তক্ষেপের কারণ?

হাইকোর্ট এই মামলায় দুদকের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। হাইকোর্টের মতে, ক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে দুদকের নোটিশগুলো দায়েরকৃত অভিযোগের ভিত্তিতে না, বরং ক্ষমতার অপব্যবহার করে জারি করা হয়েছে।

হাইকোর্ট আরও মনে করেন যে দুদকের এই হস্তক্ষেপ কোনো ভিত্তি ছাড়াই করা হয়েছে। ক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্রেশন ফি গোপনের কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই, এবং আদালত ইতিমধ্যে তাদের মালিকানা স্বীকার করেছে। ফলে, হাইকোর্ট মনে করে যে দুদকের এই হস্তক্ষেপ ক্ষমতার অপব্যবহার এবং খারাপ উদ্দেশ্যমূলক।

এই মামলাটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। দুদকের মতো সংস্থাগুলোর ক্ষমতা আছে গুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার, কিন্তু তারা যেন তাদের ক্ষমতা অপব্যবহার না করে বা কারো সাথে অন্যায় না করে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।

নিলাম ক্রয়কৃত সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে পুনরায় মামলা কি হয়রানি?

এই মামলাটি ক্রয়কারীদের জন্য কতটা হয়রানির কারণ হয়ে উঠেছে, সে বিষয়েও হাইকোর্ট উদ্বিগ্ন। ক্রয়কারীরা আইনসম্মতভাবে সম্পত্তি ক্রয় করেছেন এবং আদালত তাদের মালিকানা স্বীকার করেছেন। অথচ, দুদকের হঠাৎ হস্তক্ষেপ ও নোটিশ তাদের মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে এবং তাদের সময় ও অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য করেছে।

হাইকোর্ট মনে করেন যে দুদকের এই ধরনের হস্তক্ষেপ কেবলমাত্র অপ্রয়োজনীয় হয়রানিই সৃষ্টি করে না, বরং আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করে। এটিকে রোধ করার জন্য হাইকোর্ট দুদককে উচিত ক্ষমতা সচেতনভাবে ও আইন অনুসারে ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছে।

রেজিস্ট্রেশন ফি গোপন কি রেজিস্ট্রেশন আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য?

এই মামলায় উঠে আসা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, রেজিস্ট্রেশন ফি গোপন কি দুদক আইনের পরিবর্তে রেজিস্ট্রেশন আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ? হাইকোর্ট মনে করে যে রেজিস্ট্রেশন ফি গোপন দুদক আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে পড়ে না, বরং এটি রেজিস্ট্রেশন আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য।

ফলে, হাইকোর্ট মনে করেন যে দুদকের এই মামলাটি ভুল দিকনির্দেশে শুরু করা হয়েছে। ক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ না থাকলেও, রেজিস্ট্রেশন ফি গোপনের অভিযোগ থাকলে, সেক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন অধিদফতরই এই বিষয়টি তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা কি সীমিত?

এই মামলাটি দুদকের ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারণেও ভূমিকা রাখে। যদিও দুদক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে এই মামলা দেখায় যে তাদের ক্ষমতা সীমিত এবং সেই সীমা অতিক্রম করা যাবে না।

হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দুদকের ক্ষমতা নিম্নলিখিত বিষয়গুলো দ্বারা সীমাবদ্ধ:

  • দুদক আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধ: দুদক কেবলমাত্র দুদক আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধগুলোই তদন্ত করতে পারে। এই মামলায় রেজিস্ট্রেশন ফি গোপন দুদক আইনের অধীনে নেই, অতএব দুদকের হস্তক্ষেপ অবৈধ।
  • আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত: যখন কোনো বিষয় আদালতের দ্বারা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়, তখন দুদক সেই একই বিষয়ে পুনরায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এই মামলায় নিলাম ক্রয় আদালতের দ্বারা নিষ্পত্তি হয়েছে, অতএব দুদকের পুনরায় তদন্ত বৈধ নয়।
  • সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ: দুদক অবশ্যই তাদের অনুসরণের জন্য নির্ধারিত প্রক্রিয়া এবং নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। এই মামলায় পূর্ব-তদন্ত ছাড়াই নোটিশ জারি করা দুদকের নীতিমালা লঙ্ঘন করে।
  • ক্ষমতার অপব্যবহার: দুদকের ক্ষমতা কোনো ব্যক্তিকে হয়রানি করার বা খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। এই মামলায় হাইকোর্ট মনে করে যে দুদকের হস্তক্ষেপ হয়রানি ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই মামলাটি দুদককে তাদের ক্ষমতার সীমারেখা বুঝতে এবং আইন ও প্রক্রিয়া মেনে চলতে সাহায্য করবে। এটি আগামীতে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক দুর্নীতির বিরোধী ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে অবদান রাখবে।

বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা কি সম্ভব?

এই মামলাটি বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের চূড়ান্ততা ও পুনর্বিবেচনার বিষয়ও তুলে ধরে। যদি কোনো ব্যক্তি মনে করেন যে আদালতের সিদ্ধান্ত অসম্পূর্ণ বা ভুল, তাহলে তারা চূড়ান্ত আদালতে আপিল করতে পারেন। হাইকোর্ট বা উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত সাধারণত চূড়ান্ত মনে করা হয় এবং পুনর্বিবেচনা করা যায় না।

যদিও এই মামলায় দুদক আদালতের সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করার চেষ্টা করেছে, তবে হাইকোর্ট তাদের এই প্রচেষ্টাকে বাতিল করে দিয়েছে। [16 SCOB [2022] HCD 70]


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন