Search Suggest

বাংলাদেশে শিশু হেফাজত ও অভিভাবকত্ব: আইন ও আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি

 


বাংলাদেশে শিশু হেফাজত ও অভিভাবকত্ব: আইন ও আদালতের দৃষ্টিভঙ্গি


বাংলাদেশের আইন ও আদালতের দৃষ্টিভঙ্গিতে শিশুর হেফাজত ও অভিভাবকত্বের অধিকার নিয়ে যে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে, তা বিবাহ বিচ্ছেদ বা সম্পর্কের ভাঙনের সময় প্রায়ই দেখা যায়। বাংলাদেশে, এই ধরনের মামলাগুলি মূলত ফ্যামিলি কোর্টস অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫ (বর্তমানে পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩) এবং গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০ এর অধীনে নিষ্পত্তি করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্টএবং মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে, গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০ এর বিধান মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের উপর প্রাধান্য পাবে। 

গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট অনুযায়ী আদালতকে সেই আইন দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, যেটির অধীন সংশ্লিষ্ট অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু বা মাইনর অন্তর্ভুক্ত থাকে। গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০ এর ধারা ১৭(২) অনুসারে অভিভাবক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিশুর মঙ্গলকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আদালতকে শিশুর বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, প্রস্তাবিত অভিভাবকের চরিত্র এবং তার নিকট আত্মীয়তার বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে। এছাড়াও, যদি শিশু পর্যাপ্ত বয়সী হয় এবং বুদ্ধিদীপ্ত পছন্দ করতে পারে, তবে তার পছন্দকেও বিবেচনা করা যেতে পারে।

ফ্যামিলি কোর্টস অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫ এর ধারা ৫ অনুযায়ী শিশুদের হেফাজত ও অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যদিও এটি স্পষ্ট নয় যে, এটি অ-মুসলিমদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য কিনা, তবে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায় ও রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে এই আইন সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, ধর্ম নির্বিশেষে।

মুসলিম ও হিন্দু অভিভাবকত্বের আইনে সাধারণত পিতা শিশুর প্রাকৃতিক ও আইনগত অভিভাবক হিসাবে বিবেচিত হন। মেজরিটি অ্যাক্ট ১৮৭৫ অনুযায়ী, শিশুর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত পিতা আইনি ও প্রাকৃতিক অভিভাবক থাকেন। মুসলিম আইনে মাইনরের ব্যক্তি অভিভাবকত্বকে ওয়ালাইয়াত-এ-নাফস এবং মাইনরের হেফাজতকে হিজানাত বলা হয়। যদিও মুসলিম আইনে মা প্রাকৃতিক অভিভাবক হিসেবে বিবেচিত নন, তবে তার সন্তানের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত হেফাজতের অধিকার রয়েছে। মুসলিম আইনের অধীনে, সাধারণ নিয়ম হল মা তার সন্তানের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত হেফাজতের অধিকারী হন। 

ধর্মের পাশাপাশি বয়সের ভিত্তিতে শিশুদের হেফাজত নির্ধারণ করা হয়। যদি সন্তান পুত্র হয়, তবে মা তার হেফাজতের অধিকারী হন যতক্ষণ না সে সাত বছর বয়সে পৌঁছায়। যদি সন্তান কন্যা হয়, তবে মা হেফাজতের অধিকারী হন যতক্ষণ না কন্যা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছায়, যা সাধারণত ১৫ বছর। তবে যদি মা পুনরায় বিবাহ করেন বা তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠে, তাহলে তিনি এই অধিকার হারাতে পারেন।

হিন্দু মাইনরিটি অ্যান্ড গার্ডিয়ানশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৬ এর অধীনে মা শিশুর পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত হেফাজতের অধিকারী। পিতা দুই ধাপে সন্তানের হেফাজতের অধিকারী হন। প্রথমত, সাত বছরের কম বয়সী ছেলে এবং বয়ঃসন্ধি পূর্ণ না হওয়া কন্যার ক্ষেত্রে পিতা মায়ের অনুপস্থিতিতে বা মায়ের পরবর্তী নারী আত্মীয়দের অনুপস্থিতিতে হেফাজতের অধিকারী হন। দ্বিতীয়ত, সাত বছরের বেশি বয়সী ছেলে এবং বয়ঃসন্ধি পূর্ণ করা কন্যার ক্ষেত্রে পিতা প্রাকৃতিক অভিভাবক হিসাবে তাদের হেফাজতের অধিকারী হন।

তবে আদালত শিশুর সর্বোচ্চ মঙ্গলের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক ক্ষেত্রে আদালত মুসলিম হানাফি আইনের বয়স নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয়ে শিশুর মঙ্গল বিবেচনায় মা বা অন্য আত্মীয়কে হেফাজত প্রদান করেছে। যেমন, জোহরা বেগম বনাম লতিফ আহমেদ মুনওয়ার মামলায় আদালত হানাফি বয়স নিয়মকে অগ্রাহ্য করে মা-কে হেফাজত প্রদান করে।

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, শিশুর হেফাজত সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো এখন বেশি করে শিশুর সর্বোচ্চ মঙ্গলকে গুরুত্ব দিচ্ছে, যা বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থার একটি প্রগতিশীল উন্নয়ন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন