Search Suggest

ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন: ধারা ১৭৩এ একটি শুভঙ্করের ফাঁকি?


ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন: ধারা ১৭৩এ একটি শুভঙ্করের ফাঁকি?

সম্প্রতি ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ সংশোধন করে একটি নতুন ধারা ১৭৩এ সন্নিবেশ করা হয়েছে। এই ধারার মূল উদ্দেশ্য হলো, তদন্তাধীন কোনো মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের পূর্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত প্রতিবেদন তলব করা এবং অপর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কোনো অভিযুক্তকে সাময়িকভাবে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার একটি বিধান তৈরি করা। আপাতদৃষ্টিতে এই পদক্ষেপকে বিচারপ্রার্থী মানুষের ভোগান্তি লাঘবের একটি উপায় বলে মনে হলেও, এর গঠন এবং প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা নিয়ে গভীর পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে। আমি মনে করি, এই সংশোধনটি একটি "শুভঙ্করের ফাঁকি" মাত্র, যা মূল সমস্যার সমাধান না করে নতুন কিছু জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।

নতুন ধারা ১৭৩এ কী বলছে?


এই ধারার মূল বিষয়বস্তু হলো:
১. মামলার তদন্ত চলাকালীন যেকোনো পর্যায়ে পুলিশ কমিশনার, জেলার পুলিশ সুপার বা তদন্ত তত্ত্বাবধানকারী সমমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে মামলার অগ্রগতির বিষয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত প্রতিবেদন চাইতে পারবেন।

২. উক্ত প্রতিবেদনে যদি কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অপর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের কথা বলা হয়, তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে সেই প্রতিবেদন আদালতে পাঠানো যাবে। আদালত সন্তুষ্ট হলে উক্ত অভিযুক্তকে অব্যাহতি দিতে পারবেন।

৩. তবে এই অব্যাহতি চূড়ান্ত নয়। পরবর্তীতে চূড়ান্ত তদন্তে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ও সারবত্তামূলক প্রমাণ পাওয়া গেলে, চূড়ান্ত পুলিশি প্রতিবেদনে তার নাম পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।

সংশোধনীর প্রধান দুর্বলতা ও উদ্বেগসমূহ


১. বিচারিক এখতিয়ারের অনুপস্থিতি:

এই ধারার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন চাওয়ার ক্ষমতা একচেটিয়াভাবে পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হাতে দেওয়া হয়েছে। এখানে মহামান্য আদালতের কোনো স্বতঃপ্রণোদিত এখতিয়ার রাখা হয়নি। একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর তদন্ত শেষ না করলে, ভুক্তভোগী পক্ষ আদালতের কাছে প্রতিকার চেয়ে এমন কোনো অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন চাওয়ার আবেদন করতে পারে না। অথচ, বিচারিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। মহামান্য আদালত যদি মনে করেন কোনো মামলায় অযথা বিলম্ব হচ্ছে বা কাউকে অকারণে হয়রানি করা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আদালতের সরাসরি এমন প্রতিবেদন তলব করার ক্ষমতা থাকা উচিত ছিল। এই ক্ষমতা কেবল পুলিশ কমিশনার বা এসপি-র হাতে থাকায় বিচারিক তদারকির একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ নষ্ট হয়েছে।

২. সময়সীমার অস্পষ্টতা:

আইনে বলা হয়েছে "তদন্ত শেষ হওয়ার পূর্বে" এই প্রতিবেদন চাওয়া যাবে। কিন্তু কখন বা কতদিনের মধ্যে এই প্রতিবেদন চাইতে হবে বা চাওয়া যাবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। ফলে, এই ক্ষমতা প্রয়োগ সম্পূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার মর্জির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তিনি চাইলে ঘটনার এক বছর পরেও প্রতিবেদন চাইতে পারেন, আবার না-ও চাইতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা, যেমন - এজাহার দায়েরের ৯০ বা ১২০ দিনের মধ্যে, বেঁধে দেওয়া হলে এই বিধানের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেত এবং এটি একটি নিয়মের মধ্যে আসত।

৩. সংক্ষুব্ধ পক্ষের অধিকারহীনতা:

এই ধারায় ভুক্তভোগী বা অভিযুক্ত পক্ষের কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। একজন ব্যক্তি, যিনি মনে করছেন যে তার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই মামলা চলছে, তিনি এই ধারার অধীনে কোনো আবেদন করতে পারবেন না। তাকে সম্পূর্ণরূপে পুলিশ কমিশনার বা এসপি-র বিবেচনার ওপর নির্ভর করতে হবে। একইভাবে, মামলার বাদী পক্ষও যদি মনে করে যে তদন্ত বিলম্বিত হচ্ছে, তারও কোনো প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ এখানে রাখা হয়নি। এটি ন্যায়বিচারের নীতির পরিপন্থী, যেখানে প্রতিটি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির প্রতিকার চাওয়ার অধিকার থাকা উচিত।

৪. ‘অপর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ’ এর অস্পষ্টতা:

অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে "অপর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ" বলতে কী বোঝানো হবে, তার কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা বা মাপকাঠি এই ধারায় দেওয়া হয়নি। ফলে, এটিও একজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল। যা একজনের কাছে অপর্যাপ্ত, তা অন্যজনের কাছে তদন্তের জন্য যথেষ্ট বলে মনে হতে পারে। এই অস্পষ্টতা ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করতে পারে। প্রভাবশালী কোনো অভিযুক্তকে অপর্যাপ্ত প্রমাণের অজুহাতে অব্যাহতি দেওয়ার একটি সহজ পথ তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

৫. সাময়িক মুক্তি এবং অনিশ্চয়তা:

ধারা ১৭৩এ(৩) অনুযায়ী, অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অব্যাহতি পাওয়া কোনো ব্যক্তিকে চূড়ান্ত তদন্তে প্রমাণ সাপেক্ষে পুনরায় অভিযুক্ত করা যাবে। এর অর্থ হলো, এই অব্যাহতি কোনো চূড়ান্ত মুক্তি নয়। এটি একজন ব্যক্তিকে সাময়িক স্বস্তি দিলেও, তার মাথার ওপর মামলাটি একটি ঝুলন্ত তরবারির মতো ঝুলে থাকবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল না হওয়া পর্যন্ত। এই বিধানটি একদিকে যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনই এটি অভিযুক্তের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এবং অনিশ্চয়তা তৈরি করে।

উপসংহার


নিঃসন্দেহে, দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমানোর চিন্তা থেকে এই সংশোধনীর অবতারণা। এর উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু বর্তমান কাঠামোতে ধারা ১৭৩এ একটি অসম্পূর্ণ ও দুর্বল বিধান হিসেবেই প্রতিভাত হচ্ছে। বিচারিক এখতিয়ারের অনুপস্থিতি, সময়সীমার অভাব এবং সংক্ষুব্ধ পক্ষের অধিকার না থাকায় এটি তার মূল উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হতে পারে এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের হাতিয়ারে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
এই ধারাকে কার্যকর করতে হলে এতে বিচারিক তদারকির সুযোগ অন্তর্ভুক্ত করা, প্রতিবেদন চাওয়ার জন্য একটি যৌক্তিক সময়সীমা নির্ধারণ করা এবং অভিযুক্ত বা ভুক্তভোগী পক্ষের আবেদন করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। অন্যথায়, এই আইনি পরিবর্তনটি কেবল একটি কাগুজে বিধান হিসেবেই থেকে যাবে, যা বিচারপ্রার্থী জনগণের প্রকৃত কোনো উপকারে আসবে না।

মো: আজাদুর রহমান 
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট 
এবং আইন গ্রন্থ প্রণেতা।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন