
৭৫ ডিএলআর (এডি) ১২৫: হিন্দু আইনে নারীর 'স্ত্রীধন' ও কন্যার উত্তরাধিকারের যুগান্তকারী বিশ্লেষণ
মামলার সাইটেশন: 75 DLR (AD) 125
মূল ইস্যু: দায়ভাগ আইনে মায়ের 'স্ত্রীধন' সম্পত্তি কন্যার হাতে হস্তান্তরিত হলে তা কি 'সীমিত স্বার্থ' (Limited Estate) হিসেবে গণ্য হবে, নাকি 'পরম সম্পত্তি' (Absolute Property) হিসেবে গণ্য হবে?
১. প্রেক্ষাপট ও ঘটনার সংক্ষিপ্তসার
মামলাটি মূলত একটি স্বত্ব ঘোষণার মোকদ্দমা। বিরোধীয় জমির মূল মালিক ছিলেন রুক্ষিনী দাসী, যিনি এই সম্পত্তিটি নিজের 'স্ত্রীধন' তহবিল থেকে ক্রয় করেছিলেন। রুক্ষিনী দাসী মারা যাওয়ার পর তাঁর একমাত্র কন্যা হাজারী সুন্দরী দাসী সম্পত্তির মালিক হন। পরবর্তীতে হাজারী সুন্দরী মারা গেলে তাঁর একমাত্র কন্যা এলোকেশী মন্ডল (বাদী) সম্পত্তির উত্তরাধিকার দাবি করেন।
অন্যদিকে বিবাদীপক্ষ (রুক্ষিনী দাসীর স্বামীর ভ্রাতুষ্পুত্রগণ) দাবি করে যে, হাজারী সুন্দরী দাসী যখন তাঁর মায়ের কাছ থেকে সম্পত্তি পেয়েছিলেন, তখন তিনি কেবল 'জীবন স্বত্ব' বা সীমিত মালিকানা (Limited Interest) পেয়েছিলেন। হিন্দু আইনের পুরনো নজির অনুযায়ী, হাজারীর মৃত্যুর পর এই সম্পত্তি তাঁর নিজের উত্তরাধিকারীর (মেয়ে এলোকেশী) কাছে না গিয়ে, রুক্ষিনী দাসীর স্বামীর পুরুষ উত্তরাধিকারীদের কাছে ফিরে (Revert) যাওয়ার কথা।
২. অধস্তন আদালতসমূহের আইনি বিভ্রান্তি
বিচারিক আদালত এবং হাইকোর্ট বিভাগ বাদীর (এলোকেশী) পক্ষে রায় দিলেও, তারা একটি ভুল আইনের ওপর নির্ভর করেছিলেন। তারা 'The Hindu Law of Inheritance (Amendment) Act, 1929' প্রয়োগ করেছিলেন।
আপিল বিভাগ এই রায়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, ১৯২৯ সালের ওই আইনটি শুধুমাত্র 'মিতাক্ষরা' (Mitakshara) মতবাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাংলাদেশে যেহেতু 'দায়ভাগ' (Dayabhaga) মতবাদ প্রচলিত, তাই এই মামলার ক্ষেত্রে ১৯২৯ সালের আইন প্রয়োগ করা আইনত ভুল (Per Incuriam) ছিল।
৩. প্রিভি কাউন্সিলের নজির বাতিল ও প্রকৃত আইনের ব্যাখ্যা
এই মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রিভি কাউন্সিলের ১০৩ বছর পুরনো একটি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা। ১৯০৩ সালের Sheo Shankar Lal vs. Debi Sahai মামলায় প্রিভি কাউন্সিল বলেছিল:
"নারী থেকে নারীতে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি আর 'স্ত্রীধন' থাকে না, বরং তা সীমিত এস্টেট হয়ে যায়।"
আপিল বিভাগ এই পুরনো ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে জিমূতবাহনের (Jimuta Vahana) মূল 'দায়ভাগ' গ্রন্থের ৪র্থ অধ্যায়ের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। আদালত পর্যবেক্ষণ করেন:
দায়ভাগ মতে, মায়ের মৃত্যুর পর পুত্র এবং কন্যা "সমানভাবে" (Equally) সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন।
যদি পুত্র উত্তরাধিকারী হয়ে 'পরম মালিক' হতে পারেন, তবে কন্যা কেন 'সীমিত মালিক' হবেন? জিমূতবাহনের লেখায় কন্যাকে সীমিত মালিক করার কোনো নির্দেশ নেই।
অতএব, মা (রুক্ষিনী) থেকে কন্যা (হাজারী) যখন সম্পত্তি পান, তখন তা হাজারীর জন্য 'স্ত্রীধন' বা পরম সম্পত্তি হিসেবেই গণ্য হবে। ফলে হাজারীর মৃত্যুর পর তা তাঁর নিজের উত্তরাধিকারী অর্থাৎ তাঁর কন্যার (এলোকেশী) কাছে যাবে, স্বামীর ভাইদের কাছে নয়।
৪. সংবিধানের প্রাধান্য ও আধুনিক ব্যাখ্যা
আপিল বিভাগ কেবল ধর্মীয় গ্রন্থেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে হিন্দু আইনকে ব্যাখ্যা করেছেন। আদালত বলেন:
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা) এবং ২৮ অনুচ্ছেদ (নারী-পুরুষের সমতা) অনুযায়ী নারীর উত্তরাধিকারকে সংকুচিত করা অসাংবিধানিক মানসিকতা।
যেখানে ব্যক্তিগত আইনের (Personal Law) ভাষ্য নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ বা অস্পষ্টতা (Ambiguity) থাকে, সেখানে আদালতের দায়িত্ব হলো সংবিধানের সাম্যবাদের নীতির আলোকে সেই অস্পষ্টতা দূর করা।
৫. রায়ের সারসংক্ষেপ (Ratio Decidendi)
১. ১৯২৯ সালের আইনের অপ্রযোজ্যতা: বাংলাদেশে দায়ভাগ শাসিত হিন্দুদের ক্ষেত্রে 'The Hindu Law of Inheritance (Amendment) Act, 1929' প্রযোজ্য নয়।
২. স্ত্রীধনের উত্তরাধিকার: দায়ভাগ আইনে কোনো হিন্দু নারী উত্তরাধিকার সূত্রে (মায়ের কাছ থেকে) যে সম্পত্তি পান, তা তাঁর 'স্ত্রীধন' বা পরম সম্পত্তি হিসেবেই গণ্য হবে।
৩. উত্তরাধিকারের ক্রম: উক্ত নারীর মৃত্যুর পর সেই সম্পত্তি তাঁর নিজস্ব উত্তরাধিকারীদের (যেমন: কন্যার কন্যা) ওপর বর্তাবে। তা পূর্ববর্তী মালিকের পুরুষ জ্ঞাতিদের কাছে ফেরত যাবে না।
৬. আইনজীবীদের জন্য শিক্ষণীয় (Takeaways for Lawyers)
আরজি ড্রাফটিং বা সওয়াল-জওয়াবের সময় আর ১৯২৯ সালের আইনের দোহাই দেওয়ার প্রয়োজন নেই; সরাসরি ৭৫ ডিএলআর (এডি) ১২৫-এর নজির ব্যবহার করে হিন্দু নারীর পূর্ণ মালিকানা দাবি করা যাবে।
বিবাদীরা যদি 'বেনামি লেনদেন' বা 'যৌথ পরিবারের তহবিল' দাবি করে, তবে তা প্রমাণের জোরালো দায়িত্ব (Burden of Proof) বিবাদীর ওপরই বর্তায়, যা এই মামলায় পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
উপসংহার
৭৫ ডিএলআর (এডি) ১২৫ কেবল একটি রায় নয়, এটি বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকার রক্ষায় একটি শক্তিশালী কবচ। এই রায়ের মাধ্যমে আদালত প্রমাণ করেছেন যে, শতবর্ষী পুরনো ভুল নজিরের চেয়ে সংবিধানের সমতার নীতি এবং মূল ধর্মীয় গ্রন্থের সঠিক ব্যাখ্যা অনেক বেশি শক্তিশালী।
মোঃ আজাদুর রহমান
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
হেড অফ দ্য ফার্ম, লেক্সসোর্ড (LexSword)