ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা- অদ্ভুত কিন্তু সত্য (১ম পর্ব)

অনেক সময় আমরা রূপকথার কাহিনী শুনি। অদ্ভুত সব ঘটনা শুনি আর অবাক হই। ভাওয়াল সন্নাসী মামলার কাহিনী যেন রূপকথার কাহিনীকেও হার মানায়। এই মামলার কাহিনী অদ্ভুতুড়ে হলেও সত্য। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এই কাহিনী আমাদের বাংলাদেশের কাহিনী।  যে কাহিনী সারা বিশ্বকে সেই সময় অবাক করে দিয়েছিল। আজও সেই কাহিনী পড়লে যেন মনে হয় রূপকথার কোন কাহিনী পড়ছি।শুধু তাই নয় ফরেনসিক বিজ্ঞানের জন্য এই মামলাটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলাতে মানুষের পরিচয় বের করার কলাকৌশলের যথেষ্ট প্রয়োগ ঘটেছে।  ঘটনাটি গাজীপুরের ভাওয়াল এস্টেটকে কেন্দ্র করে। এক ব্যক্তি মারা যাওয়ার দশ বছর পর সেই ব্যক্তি হটাৎ সন্ন্যাসবেশ ধারণ করে দৃশ্যপটে হাজির হন। শুরু হয় নিজেকে জীবিত প্রমাণ করার লড়াই। সম্পত্তির হিস্যা পাওয়ার লড়াই। শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। পরিশেষে বিষয়টি আদালতে গড়ায়। লাখ লাখ মানুষের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এই মামলা। ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভাওয়াল এস্টেট ও ভাওয়াল রাজবাড়ি। তাই কাহিনী শুরু করার আগে ভাওয়াল রাজবাড়ি ও ভাওয়াল এস্টেট সম্পর্কে জানলে কাহিনীটি আরো বেশি আকর্ষণীয় হবে।


ভাওয়াল রাজবাড়ী অবিভক্ত ভারতবর্ষের বাংলা প্রদেশের ভাওয়াল এস্টেটে, বর্তমানে বাংলাদেশের গাজীপুর জেলায় অবস্থিত একটি রাজবাড়ী।বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমার অভিনীত সন্ন্যাসী রাজা নামের বাংলা ছবিটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল যার ঘটনা এই রাজবাড়িকেই ঘিরে। এই রাজবাড়ীর আওতায় ভাওয়াল এস্টেট প্রায় ৫৭৯ বর্গমাইল (১,৫০০ কিমি২) এলাকা জুড়ে ছিল যেখানে প্রায় ৫ লাখ প্রজা বাস করতো। ভাওয়ালের জমিদার বংশের রাজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায় ও আরো দুই ভাই মিলে এই জমিদারীর দেখাশোনা করতেন।

ভাওয়াল এস্টেট পরিধি এবং আয়ের দিক থেকে পূর্ব বাংলায় নওয়াব এস্টেটের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারি। ভাওয়াল জমিদার বংশের পূর্বপুরুষগণ মুন্সিগঞ্জের অন্তর্গত বজ্রযোগিনী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন বলে জানা যায়। এই বংশের জনৈক বলরাম সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভাওয়াল পরগনার জমিদার দৌলত গাজীর দীউয়ান হিসেবে কাজ করতেন। বলরাম এবং তার পুত্র শ্রীকৃষ্ণ তৎকালীন বাংলার দীউয়ান মুর্শিদকুলী খানের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন এবং কৌশলে গাজীদের বঞ্চিত করে জমিদারি হস্তগত করেন।



রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে মুর্শিদকুলী খান বহু মুসলমান জমিদারকে বিতাড়িত করে তদ্‌স্থলে হিন্দু জমিদার নিযুক্ত করেন। ভাওয়ালের গাজীগণ মুর্শিদকুলী খানের এই নীতির কারণে জমিদারি স্বত্ব হারান। ১৭০৪ সালে শ্রীকৃষ্ণকে ভাওয়ালের জমিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকে এই পরিবারটি ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে এই জমিদারির অধিকারী ছিলেন। শিকারী বেশে রমেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর পরবর্তী সময়ে ভাওয়াল পরিবার বহু ছোটোখাটো জমিদারি বা জমি ক্রয় করে একটি বিরাট জমিদারির মালিক হয়। ১৮৫১ সালে পরিবারটি নীলকর জেমস ওয়াইজ এর জমিদারি ক্রয় করে। এই ক্রয়ের মাধ্যমে পরিবারটি সম্পূর্ণ ভাওয়াল পরগনার মালিক হয়ে যায়। সরকারি রাজস্ব নথিপত্র থেকে এটি জানা যায় যে, ভাওয়ালের জমিদার ৪,৪৬,০০০ টাকা দিয়ে ওয়াইজের জমিদারি ক্রয় করেন, যা ছিল সে যুগের মূল্যমানের বিচারে বেশ বড় একটি অঙ্ক। ১৮৭৮ সালে এই পরিবারের জমিদার কালীনারায়ণ রায় চৌধুরী ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে বংশানুক্রমিক ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেন। কালীনারায়ণের পুত্র রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী এই জমিদারির আরও বিস্তৃতি ঘটান। এই সময়ই ভাওয়াল জমিদারি ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে এবং পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারিতে পরিবর্তিত হয়। উল্লেখ্য যে, যদিও ঢাকার নওয়াব এস্টেটটি পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলাসমূহে জমিদারি বিস্তৃত করেছিল এবং জমিদারির প্রশাসনিক কেন্দ্র ঢাকা শহরেই অবস্থিত ছিল, কিন্তু ঢাকা শহরের অংশবিশেষ ও আশপাশের প্রায় সকল জমির মালিক ছিলেন ভাওয়াল রাজা। ১৯১৭ সালে ভূমি জরিপ ও বন্দোবস্ত রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, ভাওয়াল পরিবারটি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ২২৭৪টি মৌজায় ৪,৫৯,১৬৩.৩ একর জমির মালিক ছিলেন। ১৯০৪ সালে জমিদারিটি সরকারকে ৮৩,০৫২ টাকা রাজস্ব হিসেবে প্রদান করে এবং সকল খরচ-খরচা বাদ দিয়ে ৪,৬২,০৯৬ টাকা নিট আয় করে।


ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার পরে জমিদারির উত্তরাধিকারের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে এবং ফলে এর ব্যবস্থাপনা ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনেই থেকে যায়। যেহেতু উত্তরাধিকারী নিয়ে বহু জটিলতা ছিল এবং জমিদারি সংক্রান্ত বহু মামলাও অমীমাংসিত ছিল, সে কারণে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণার পরেও এর বিষয়-সম্পত্তি বা দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে বণ্টন করা সম্ভব হয় নি। ফলে পাকিস্তান আমলেও জমিদারিটি কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনেই থাকে। বর্তমানে ভাওয়াল এস্টেটের কর্মকাণ্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি সংস্কার বোর্ড পরিচালনা করে।

ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা

রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি তিন পুত্র যথাক্রমে রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি, রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি ও রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি এবং তিন কন্যা যথাক্রমে ইন্দুময়ী দেবী, জ্যোতির্ময়ী দেবী এবং তড়িম্ময়ী দেবীকে রেখে ১৯০১ সালের ২৬ এপ্রিল মৃত্যু বরণ করেন। রাজ কুমারগণ নাবালক থাকায় তাঁদের মা রাণী বিলাসমণি দেবী ট্রাস্টি হিসেবে এস্টেটের পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। ১৯০৭ সালে রাণী বিলাসমণির মৃত্যুর পর তিন ভ্রাতা সমান হিস্যায় জমিদারির মালিকানা স্বত্ব লাভ করেন। রাজকুমারগণ ছিলেন মুর্খ, মদ্যপ ও অমিতাচারী। খারাপ মেয়েছেলেদের সংসর্গে থাকার কারণে মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হন। ঘরে তাঁর স্ত্রী বিভাবতী দেবী থাকা সত্ত্বেও বেশ্যালয়ে গমন থেকে বিরত থাকেননি। স্থানীয় পর্যায়ে ও কোলকাতায় চিকিৎসা গ্রহণের পরও রোগমুক্ত না হওয়ায় শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ও রাজ পরিবারের পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ আশুতোষ দাসগুপ্তের পরামর্শে ভ্রমণ, হাওয়া বদল ও চিকিৎসা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯০৯ সালের ১৮ এপ্রিল স্ত্রী বিভাবতী দেবী, শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ আশুতোষ দাসগুপ্ত, কুমারের প্রাইভেট সেক্রেটারি মুকুন্দ গুঁই, আরদালি শরীফ খাঁ পাঠান, গুর্খাগার্ড হরিসিংহ, হিসাব রক্ষক বীরেন্দ্র ব্যানার্জীসহ ২৭ জনের এক লটবহর নিয়ে মেজোকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে জয়দেবপুর ত্যাগ করেন। দার্জিলিং-এ শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ও প্রাইভেট সেক্রেটারি মুকুন্দগুঁই কর্তৃক পূর্বেই ভাড়া করা ২০১, রণজিত রোডের স্টেপএসাইড নামক বাড়িতে লটবহর নিয়ে উঠলেন রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি। এখানেই শুরু হলো ধুরন্ধর সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর ষড়যন্ত্র। তাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলো ডাঃ আশুতোষ দাস গুপ্ত।

রমেন্দ্র নারায়ণ সিফিলিসের রুগী হলেও শারীরিক ভাবে সুস্থই ছিলেন। ক’দিন আগে একটি মানুষ খেকো বাঘ শিকার করে কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। হঠাৎ ৫ মে তাঁর পেট ফুলে উঠলো। শুরু হলো পেটে ব্যাথা। ঘুম থেকে ডেকে উঠানো হলো ডাঃ আশুতোষকে। ডাঃ আশুতোষ মেজোকুমারের পেট পরীক্ষা করলেন, কিন্তু কোন ঔষধ দিলেন না। ৬ মে সকালে দার্জিলিং এর সিভিল সার্জন ইংরেজ ডাঃ টেলফার কেলভার্টকে ডাকা হলো। তিনি পেট ফাঁপা রোগের চিকিৎসা করলেন। দার্জিলিং হতে বড়কুমারের নিকট জয়দেবপুরে প্রেরিত দুই/ তিনটি টেলিগ্রামে দেখা যায় রমেন্দ্র নারায়ণের পেট ব্যথা সেরে উঠেছে, জ্বরও নেই। ৭ মে রাতে ডাঃ আশুতোষ দাসগুপ্ত দার্জিলং এর সিভিল সার্জনের সাথে আলোচনা না করে নিজে তিন বার করে খাওয়ানোর জন্য ঔষধের ব্যবস্থাপত্র দিলেন। ৮ তারিখ সকালে এবং দুপুরে টেলিগ্রাম করে জয়দেবপুরে বড়কুমার রণেন্দ্র নারায়ণকে জানানো হলো গত রাতে কুমারের সুনিদ্রা হয়েছে, জ্বর বা ব্যথা নেই। অথচ বিকেলে টেলিগ্রাম করে বড়কুমারকে জানানো হলো, ’কুমার ইস সিরিয়াসলি ইল, ফ্রি কোয়েন্টলি ওয়াটারি মোসানস উইথ ব্লাড, কাম সার্প’। বড়কুমারকে এমন সময়ে দার্জিলিংএ যেতে বলা হলো যখন ঐ দিনে যাতায়াতের আর কোন ট্রেন নেই টেলিগ্রামগুলো সুকৌশলে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে সত্যেন্দ্রনাথ ও ডাঃ আশুতোষ কর্তৃক প্রাইভেট সেক্রেটারি মুকুন্দগুঁইয়ের বরাত দিয়ে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে রমেন্দ্র নারায়ণের শারীরিক অবস্থা অবনতির শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। দার্জিলিং এর সিভিল সার্জন ডাঃ কেলভার্ট এবং সরকারি ডাঃ নিবারণ চন্দ্র এসে চিকিৎসা করলেন। মরফিন ইনজেকশনও দেয়া হলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। রাত ৮টার দিকে কুমারের শরীর ধীরে ধীরে হিম শীতল হয়ে গেল। রাত ৮.৩০ টার দিকে জয়দেবপুরে টেলিগ্রাম করে মেজোকুমারের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হলো।



ঐদিন রাতে রমেন্দ্র নারায়ণের শবদেহ পোড়ানোর পুরোহিত ও শ্মশান যাত্রী জোগাড় করে দার্জিলিং এর পুরাতন শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হলো। হিন্দু শাস্ত্রানুসারে মুখাগ্নি দেয়ার মতো কেহ উপস্থিত না থাকলে বিধবা স্ত্রী মুখাগ্নি করবে। কিন্তু মুখাগ্নির জন্য বিভাবতীকে সংগে নেয়া হলো না। মৃতদেহ পোড়ানোর উদ্দেশ্যে চিতা সাজানোর জন্য একটি ভালো জায়গা খোঁজা হচ্ছিল। এর মধ্যে শুরু হলো প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি। শ্মশান যাত্রীরা বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার। একটু আশ্রয় নেয়ার জন্য মুখাগ্নির পর শবদেহ শ্মশানে রেখে তারা দৌঁড়ে চলে গেল অন্যত্র। ঝড়-বৃষ্টি কমে গেলে শ্মশান যাত্রীরা এসে আর মৃতদেহ পায়নি। মৃতদেহ খোঁজা শুরু হলো। না পেয়ে শ্মশান যাত্রীরা ফিরে গেল যার যার আস্তানায়। এ দিকে সত্যেন্দ্রনাথ এবং ডাঃ আশুতোষ শুরু করলো আরেক ষড়যন্ত্র। তারা সেই রাতে অর্থের বিনিময়ে জোগাড় করলো একটি মৃতদেহ। মৃতদেহটি খাটিয়ায় রেখে সাদা কাপড়ে আবৃত করে রাখা হলো। এর পর ৯ মে সকালে পার্শ্ববর্তী পরিচিত ও অপরিচিত লোকজনকে খবর দেয়া হলো। শবদেহ পোড়ানো ও বহনের জন্য অর্থের বিনিময়ে লোক জোগাড় করা হলো। কৌশলে পরিচিত কাউকে মৃতদেহ হতে কাপড় সরিয়ে দেখতে দেয়া হলো না। অতঃপর সকাল ৮টার দিক মৃতদেহ দার্জিলিং শ্মশানে নিয়ে দাহ করা হলো। পরিশেষে ১০ মে মধ্যরাতে মেজো কুমারের বিধবা স্ত্রী বিভাবতী দেবী, ডাঃ আশুতোষ দাসগুপ্ত, শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীসহ সংগীয় অন্যান্য কর্মচারীরা ফিরে এলো জয়দেবপুর।

আরদালি শরীফ খাঁ মেজোকুমারকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতো। সে ছিলো বিশ্বস্ত ভৃত্য। রমেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যুতে সে শোকে উম্মাদ। শরীফ খাঁ রাণী সত্যভামাকে জানায় যে, সত্যেন্দ্র নাথের উপস্থিতিতে ডাঃ আশুতোষ ছোট একটি কাঁচের গ্লাসে করে ঔষধ খাওয়ালেন। অসুস্থ মেজোকুমার কিছুটা ঔষধ খেতে পারলেন, কিছুটা উগরিয়ে ফেলে দিলেন। ঔষধ খাওয়ার পর মেজোকুমার চিৎকার করে বললেন আশু, তুমি আমায় কি খাওয়ালে? ঔষধের কিছু অংশ তাঁর কাপড়ে পড়ে কাপড় পুড়ে গিয়েছিল, কিছুটা থুথু বা লালা তাঁর ডান উরুতে লেগে ঘা হয়ে গিয়েছে। শরীফ খাঁ এসব দেখালো। অনেকেই এ কথা শুনতে পেল। জ্যোতির্ময়ী দেবী শরীফ খাঁ ও বীরেন্দ্র ব্যানার্জীকে ডেকে শুনতে পেল কুমারের দেহ দাহ হয়নি। খবরটি রটে গেল চারিদিকে। অনেকেরই বিশ্বাস জন্মালো রমেন্দ্র নারায়ণের মৃতদেহ শ্মশান থেকে উধাও হয়ে গেছে এবং দাহ হয়নি। তাদের এও বিশ্বাস জন্মালো যে, কুমার মরে নাই, বেঁচে আছে। বিভাবতী দেবীর ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ডাক্তারি সনদ, শবদেহ দাহ করার প্রত্যয়ন পত্রসহ কয়েক জনের মৌখিক বক্তব্য দিয়ে বিশ্বাস জন্মাতে প্রয়াস পায় যে, মেজোকুমারের মৃতদেহ উধাও হয়নি; বরং যথারীতি পুড়িয়ে ফেলানো হয়েছে। এগার দিন পর মেজোকুমারের শ্রাদ্ধের দিন জ্যোতির্ময়ী দেবী, রাণী সত্যভামা দেবীসহ আরো অনেকে বেঁকে বসলেন যে, মৃতদেহ দাহিত না হলে শ্রাদ্ধ করা যায় না। শেষ পর্যন্ত ঘাস দিয়ে মেজোকুমারের কুশপুত্তলিকা বানিয়ে দাহ করে শ্রাদ্ধের কাজ সম্পন্ন করা হয়। জ্যোতির্ময়ী দেবী এবং রাণী সত্যভামার সন্দেহ থাকার কারণে তাঁরা সম্ভব্যস্থানে মেজোকুমারের খোঁজ নিতে লোক পাঠিয়ে দেন। এ দিকে সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকায় বাড়ি ভাড়া করে তাঁর মাকে নিয়ে এলেন। তারপর মায়ের দোহাই দিয়ে জয়দেবপুর থেকে বিভাবতীকে নিয়ে এলেন ঢাকায়। 

বিভাবতীর অভিভাবক হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ মেজোকুমারের ইন্সুরেন্সের ৩০ হাজার টাকা তুলে নিলেন। আর জমিদারির এক তৃতীয়াংশের আয়ও গ্রহণ করলেন। ইন্সুরেন্সের টাকায় কোলকাতার ১৯নং ল্যান্স ডাউন রোডে নিজ নামে বাড়ি খরিদ করলেন এবং সেই সাথে দুটো গাড়িও। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সে বাড়িতে উঠালেন বোন বিভাবতীকে। ব্রিটিস সরকার কোর্ট আব ওয়ার্ডস আইনের আওতায় ভাওয়াল রাজ্য পরিচালনার ভার গ্রহণ করলেও রাজকুমারের বিধবা পত্নিগণ নিয়মিতভাবে ভাতা ও লভ্যাংশ পেতেন। বিভাবতীর অংশ গ্রহণ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। এক হিসেবে দেখা যায় ১৯০৯ সাল হতে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ভাওয়াল এস্টেট থেকে তিনি গ্রহণ করেছেন ১৯ লক্ষ টাকা। অপর দিকে ভাওয়াল রাজ এস্টেটের এক তৃতীয়াংশ দেখভালের অভিভাবকত্ব হেতু ইংরেজ কর্মচারীদের সাথে উঠাবসার সুবাদে উপাধি গ্রহণ করেছেন রায় চৌধুরী। অর্থাৎ জমিদার সত্যেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। ওদিকে জ্যেতির্ময়ী দেবী ও রাণী সত্যভামা দেবীর মত ভাওয়াল রাজ এস্টেটের প্রজাবৃন্দ বিশ্বাস করেন যে, মেজোকুমার বেঁচে আছেন এবং একদিন তিনি সন্ন্যাসী বেশে ভাওয়াল রাজ্যে ফিরে আসবেন। প্রকৃতপক্ষে ৮মে ১৯০৯ সালে রাতে দশ এগারটার সময়ে রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরির মৃতদেহ দাহ করার জন্য দার্জিলিং পুরাতন শ্মশানে নেয়ার পর শুরু হলো তুমুল ঝড় বৃষ্টি। সেখানে কোন আশ্রয় স্থল না থাকায় শবযাত্রীরা আশ্রয় লাভের আশায় শ্মশান ঘাট হতে দৌঁড়ে সরে গিয়েছিল।
  • [accordion]
    • লেখক সম্পর্কে জানুন
      • পোস্টটি লিখেছেন- [ মোঃ আজাদুর রহমান ##pencil##] তিনি লিগ্যাল ভয়েস ব্লগের এডমিন ও সম্পাদক। পেশাগত জীবনে তিনি আইনজীবী হিসেবে ঢাকা জজ কোর্টে কর্মরত আছেন।
    • ফ্রি আইনি পরামর্শ পাবেন যেভাবে
      • আইন সচেতন সোনার বাংলা গঠনের মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে লিগ্যাল ভয়েসের যাত্রা শুরু হয়েছে। যারা শহরে বসবাস করেন তারা কোন আইনি জটিলতায় পড়লে খুব সহজেই একজন আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করে আইনি সমস্যার সমাধান করতে পারেন। কিন্তু যারা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন তারা কোন আইন সমস্যায় পড়লে দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাসের কারণে আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ করা দুরুহ হয়ে পড়ে। ফলে সমস্যা দিন দিন জটিল হতে থাকে। সঠিক পরামর্শের অভাবে অনেকেই সঠিক পদক্ষেপ না নিয়ে পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল করে তোলেন। ফলে সমস্যা থেকে উত্তরণের কোন পথ তো পানই না উল্টো মানসিক ও শারিরীকভাবে ভেঙে পড়েন। তাদের কথা মাথায় রেখে লিগ্যাল ভয়েস কর্তৃপক্ষ প্রশ্নোত্তর বিভাগ চালু করেছে। আপনি খুব সহজেই আমাদেরকে আপনার আইনি সমস্যার কথা জানাতে পারবেন। পাবেন আইনি সমস্যা থেকে উত্তরণের সঠিক পথ। আমাদের প্রশ্নোত্তর বিভাগে যুক্ত হতে [ এখানে ক্লিক করুন। ] 
    • আপনিও লিখুন আমাদের ব্লগে!
      • সুপ্রিয় লিখিয়ে পাঠক! আপনি জেনে নিশ্চয় আনন্দিত হবেন যে, আইন সচেতন সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সচেতন নাগরিক হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আমাদের এই উদ্যোগ। চাইলে আপনিও হতে পারেন এই গৌরবের একজন গর্বিত অংশীদার। আমাদের ব্লগে নিবন্ধন করে আপনিও হতে পারেন আমাদের সম্মানিত লেখক। লিখতে পারেন আইন-আদালত, পরিবেশ, ইসলামী আইন যেমন কোরআন, হাদিসের আইনগত বিষয়, প্রাকৃতিক আইন, বিভিন্ন অপরাধ সম্পর্কিত প্রতিবেদন বা অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি, অন্যায়, দূর্নীতি, হয়রানী, ইভটিজিং, বেআইনী ফতোয়া, বাল্য বিবাহ ইত্যাদিসহ যাবতীয় আইনগত বিষয়াবলী নিয়ে। আমাদের ব্লগের সদস্য হোন আর হারিয়ে যান জ্ঞান বিকাশের এক উন্মুক্ত দুনিয়ায়!
    • আমাদের কথা
      • লিগ্যাল ভয়েস হলো দেশের  সর্ববৃহৎ এবং একমাত্র আইন সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ বাংলা ব্লগ কমিউনিটি। প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজের মানুষ সচেতনভাবে কিংবা অসচেতনভাবে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন আইনগত জটিলতায় পড়ে জীবন নষ্ট করে ফেলছে। অনেক সময় আইন না জানার কারণে আমাদেরকে বিভিন্ন ভোগান্তির শিকার হতে হয়। একটু আইন জানলে হয়তো এসব ভোগান্তি হতে নিজেকে রক্ষা করা যেত। আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হলো আইন না জানা কোন অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ কেউ কোন অপরাধ করে যদি বলে আমি আইনটি জানতাম না। জানলে এই অপরাধ টি করতাম না। আইনে এই অজুহাতের কোন গ্রহনযোগ্যতা নেই। কাজেই আইন জানা ছাড়া আমাদের অন্য কোন বিকল্পও নেই। দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে আমাদের বিভিন্ন আইনী জটিলতায় পড়তে হয়। তাই আইন কানুন সম্পর্কে জ্ঞান রাখা আবশ্যক। আইন জানা আমাদের জন্য এমন অপরিহার্য্য বিষয় হলেও আইন জানার জন্য আমাদের দেশে ভাল কোন প্ল্যাট ফর্ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয় বা ল কলেজ গুলোর বিষয় আলাদা। তাই সাধারণ মানুষের দোর গোড়ায় টুকিটাকি আইন কানুন পৌছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই ২০১৮ সালের ফ্রেব্রুয়ারী মাসে লিগ্যাল ভয়েসের যাত্রা শুরু। আইন সচেতন সোনার বাংলা গঠন করাই লিগ্যাল ভয়েসের মূল উদ্দেশ্য। বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে লিগ্যাল ভয়েস সাধারণ মানুষের আইন শেখার পিপাসা নিবারণ করে থাকে। এ ছাড়া লিগ্যাল ভয়েস যে কোন ধরনের আইনগত সমস্যায় বিনা খরচে পরামর্শ প্রদান করে থাকে। আমাদের সাথে থাকার জন্য সকল পাঠককে আন্তরিক শুভেচ্ছা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.