যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০ রহিতক্রমে ২০১৮ সালে নতুন করে যৌতুক নিরোধ আইন পাশ করা হয়েছে।যৌতুক আইনের অপব্যবহার করে এক শ্রেণীর নারীরা আদালতে মিথ্যা মামলা দায়ের করে পুরুষদেরকে হয়রানি করতো।আইনের এই অপব্যবহার রোধে কার্যকর কোন ধারা সন্নিবেশিত না থাকায় মূলত: ১৯৮০ সালের আইনটি বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। এছাড়া যৌতুকের সংজ্ঞাসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আদালতে ধুম্রজাল সৃষ্টি হওয়ায় নতুন করে আইন প্রণয়ন করার দাবি ওঠে। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে যৌতুক নিরোধ আইনটি নতুন করে প্রণয়ন করা হয়। ১৯৮০ সালের আইন এবং ২০১৮ সালের নতুন আইন পাশাপাশি রাখলে বেশ কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে।
বিয়ের পক্ষ
১৯৮০ সালের আইনটি ইংরেজিতে ছিল কিন্তু ২০১৮ সালের নতুন আইনটি বাংলায় প্রণয়ন করা হয়েছে। পুরাতন আইনে বিবাহের পক্ষের কোন সংজ্ঞা দেয়া হয়নি কিন্তু নতুন আইনে প্রথমেই বিয়ের পক্ষগণের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। নতুন আইনে ‘‘পক্ষ’’ অর্থ এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, বিবাহের বর বা কনে অথবা বর বা কনের পিতা-মাতা অথবা বর বা কনের পিতা-মাতার অবর্তমানে বৈধ অভিভাবক অথবা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সহিত জড়িত বর বা কনে পক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তি।
যৌতুকের সংজ্ঞা
পুরাতন আইনে যৌতুক এর যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে বিষয়বস্তু প্রসঙ্গের পরিপন্থী না হইলে এই আইনে “যৌতুক” বলিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, প্রদত্ত যে কোন সম্পত্তি বা “মূল্যবান জামানত”কে বুঝাইবে, যাহা-
ক) বিবাহের একপক্ষ অপরপক্ষে অথবা
খ) বিবাহের কোন একপক্ষের পিতামাতা বা অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক বিবাহের যে কোন পক্ষকেবা অন্য কোন ব্যক্তিকে বিবাহ মজলিশে অথবা বিবাহের পূর্বে বা পরে, বিবাহের পণরূপে প্রদান করে বা প্রদান করিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় : তবে, যৌতুক বলিতে মুসলিম ব্যক্তগত আইন (শরিয়ত) মোতাবেক ব্যবস্থিত দেনমোহর বা মোহরানা বুঝাইবে না।
ব্যাখ্যা : ১) সন্দেহ নিরসনকল্পে এতদ্বারা জ্ঞাত হইল যে, বিবাহের সহিত সরাসরি সম্পর্কিত নহেন এমন কোন ব্যক্তিকর্তৃক স্বামী বাস্ত্রী, যে কোন পক্ষকে অনধিক পাঁচশত টাকা মূল্যমানের কোন জিনিস, বিবাহের পণ হিসাবে নহে, উপঢৌকনরূপে প্রদান করিলে, অনুরূপ উপঢৌকন এই ধারা মতে যৌতুক হিসাবে গণ্য হইবে না।
ব্যাখ্যা : ২) দন্ডবিধির (ইং ১৯৮০ সালের ৪৫ নম্বর আইনের) ৩০ ধারায় “মূল্যবান জামানত” যে অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে, এই আইনেও ঐ শব্দাবলী একই অর্থ বুঝাবে।
নতুন আইনে যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘‘যৌতুক’’ অর্থ বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের নিকট বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসাবে বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ অব্যাহত রাখিবার শর্তে, বিবাহের পণ বাবদ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, দাবিকৃত বা বিবাহের এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষেকে প্রদত্ত বা প্রদানের জন্য সম্মত কোনো অর্থ-সামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদ, তবে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়াহ্) প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তিগণের ক্ষেত্রে দেনমোহর বা মোহরানা অথবা বিবাহের সময় বিবাহের পক্ষগণের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা শুভাকাঙ্ক্ষী কর্তৃক বিবাহের কোনো পক্ষকে প্রদত্ত উপহার-সামগ্রী ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবে না।
নতুন আইনে ব্যাখ্যা উঠিয়ে দিয়ে সংজ্ঞার ভিতরে বিস্তারিত বলে দেয়া আছে কোনগুলো যৌতুক আর কোনগুলো যৌতুকের অন্তর্ভূক্ত নয়। “এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের নিকট বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসাবে/বিবাহ অব্যাহত রাখিবার শর্তে,” কথাগুলো সংযোজন করা হয়েছে যা নিয়ে এতদিন যৌতুক আইন ব্যাখ্যার সময় ধুম্রজাল সৃষ্টি হত।
যৌতুক দাবি করিবার দণ্ড
পুরাতন আইনের চার ধারায় যৌতুক দাবি করার শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছিল। এই ধারা মতে কোন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কনে বা বরের পিতামাতা বা অভিভাবকের নিকট যৌতুক দাবী করিলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কিন্তু অন্যূন ১ (এক) বৎসর কারাদণ্ড বা অর্থদন্ড অথবা উভয় বিধ প্রকারে দন্ডনীয় হইবে।
এই আইন অনুসারে অপরাধ হতে হলে যে কোন ব্যক্তি কর্তৃক ত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কনে বা বরের পিতামাতা বা অভিভাবকের নিকট যৌতুক দাবী করা লাগত। বর বা কনের নিকট যৌতুক দাবি করলে সেটা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো না এবং সাজা হিসেবে কারাদন্ডের পরিমাণ থাকলেও অর্থদন্ডের কোন পরিমাণ উল্লেখ ছিল না।
কিন্তু নতুন আইনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কনে বা বরের পিতামাতা বা অভিভাবকের নিকট যৌতুক দাবী না করে শুধুমাত্র বর বা কনের নিকট যৌতুক দাবি করলেও তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই আইনের তিন ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি বিবাহের কোনো এক পক্ষ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, বিবাহের অন্য কোনো পক্ষের নিকট কোনো যৌতুক দাবি করেন, তাহা হইলে উহা হইবে এই আইনের অধীন একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কিন্তু অন্যূন ১ (এক) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।
এখানে এক পক্ষ আরেক পক্ষের নিকট যৌতুক দাবি করলেই সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবে। আর পক্ষের সংজ্ঞায় আমরা আগেই দেখেছি পক্ষ অর্থ বর বা কনেকেও অন্তভুক্ত করে।
মিথ্যা মামলা দায়ের, ইত্যাদির দণ্ড
পুরুষের জন্য সবচেয়ে সহায়ক যে ধারাটি নতুন আইনে সংযোজন করা হয়েছে তা হলো ৬ নং ধারা। এই ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অধীনে মামলা বা অভিযোগ করিবার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জানিয়াও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
কোন ব্যক্তি যদি শুধুমাত্র অপর ব্যক্তিকে হয়রানি বা ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে এই আইনের অপব্যবহার করে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন তাহলে তিনি মিথ্যা মামলা করার জন্য শাস্তি পাবেন। এই বিধানটি পুরাতন আইনে ছিল না।
আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় হলো পুরাতন আইনে অপরাধ আমলে নেয়ার ক্ষেত্রে তামাদির বিধান থাকলেও নতুন আইনে এই বিধানটি উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। যৌতুকের অপরাধ সংঘঠিত হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী এক বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করার বাধ্যবাধকতা ছিল পুরাতন আইনটিতে। এক বছরের পর মামলা দায়ের করলে সেই মামলা চলতো না। তবে নতুন আইনে এই বিধানটি বাতিল করা হয়েছে। এখন যৌতুক আইনে মামলা করতে বাধা ধরা কোন সময় নেই।
যদিও যৌতুক আইনে নারী পুরুষের বিরুদ্ধে এবং পুরুষ নারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে তবুও দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরাই পুরুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে পুরুষকে হয়রানি করে থাকে। তবে মিথ্যা মামলা করার বিষয়টি প্রমাণিত হলে বর্তমানে আইনেই মিথ্যা মামলা দায়ের কারীর বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেয়া যাবে যেটি পুরুষের জন্য কিছুটা হলেও সহায়ক হবে।
- [accordion]
- লেখক সম্পর্কে জানুন
- পোস্টটি লিখেছেন- [ মোঃ আজাদুর রহমান ##pencil##] তিনি লিগ্যাল ভয়েস ব্লগের এডমিন ও সম্পাদক। পেশাগত জীবনে তিনি আইনজীবী হিসেবে ঢাকা জজ কোর্টে কর্মরত আছেন।
- ফ্রি আইনি পরামর্শ পাবেন যেভাবে
- আইন সচেতন সোনার বাংলা গঠনের মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে লিগ্যাল ভয়েসের যাত্রা শুরু হয়েছে। যারা শহরে বসবাস করেন তারা কোন আইনি জটিলতায় পড়লে খুব সহজেই একজন আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করে আইনি সমস্যার সমাধান করতে পারেন। কিন্তু যারা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন তারা কোন আইন সমস্যায় পড়লে দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাসের কারণে আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ করা দুরুহ হয়ে পড়ে। ফলে সমস্যা দিন দিন জটিল হতে থাকে। সঠিক পরামর্শের অভাবে অনেকেই সঠিক পদক্ষেপ না নিয়ে পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল করে তোলেন। ফলে সমস্যা থেকে উত্তরণের কোন পথ তো পানই না উল্টো মানসিক ও শারিরীকভাবে ভেঙে পড়েন। তাদের কথা মাথায় রেখে লিগ্যাল ভয়েস কর্তৃপক্ষ প্রশ্নোত্তর বিভাগ চালু করেছে। আপনি খুব সহজেই আমাদেরকে আপনার আইনি সমস্যার কথা জানাতে পারবেন। পাবেন আইনি সমস্যা থেকে উত্তরণের সঠিক পথ। আমাদের প্রশ্নোত্তর বিভাগে যুক্ত হতে [ এখানে ক্লিক করুন। ]
- আপনিও লিখুন আমাদের ব্লগে!
- সুপ্রিয় লিখিয়ে পাঠক! আপনি জেনে নিশ্চয় আনন্দিত হবেন যে, আইন সচেতন সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সচেতন নাগরিক হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আমাদের এই উদ্যোগ। চাইলে আপনিও হতে পারেন এই গৌরবের একজন গর্বিত অংশীদার। আমাদের ব্লগে নিবন্ধন করে আপনিও হতে পারেন আমাদের সম্মানিত লেখক। লিখতে পারেন আইন-আদালত, পরিবেশ, ইসলামী আইন যেমন কোরআন, হাদিসের আইনগত বিষয়, প্রাকৃতিক আইন, বিভিন্ন অপরাধ সম্পর্কিত প্রতিবেদন বা অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি, অন্যায়, দূর্নীতি, হয়রানী, ইভটিজিং, বেআইনী ফতোয়া, বাল্য বিবাহ ইত্যাদিসহ যাবতীয় আইনগত বিষয়াবলী নিয়ে। আমাদের ব্লগের সদস্য হোন আর হারিয়ে যান জ্ঞান বিকাশের এক উন্মুক্ত দুনিয়ায়!
- আমাদের কথা
- লিগ্যাল ভয়েস হলো দেশের সর্ববৃহৎ এবং একমাত্র আইন সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ বাংলা ব্লগ কমিউনিটি। প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজের মানুষ সচেতনভাবে কিংবা অসচেতনভাবে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন আইনগত জটিলতায় পড়ে জীবন নষ্ট করে ফেলছে। অনেক সময় আইন না জানার কারণে আমাদেরকে বিভিন্ন ভোগান্তির শিকার হতে হয়। একটু আইন জানলে হয়তো এসব ভোগান্তি হতে নিজেকে রক্ষা করা যেত। আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হলো আইন না জানা কোন অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ কেউ কোন অপরাধ করে যদি বলে আমি আইনটি জানতাম না। জানলে এই অপরাধ টি করতাম না। আইনে এই অজুহাতের কোন গ্রহনযোগ্যতা নেই। কাজেই আইন জানা ছাড়া আমাদের অন্য কোন বিকল্পও নেই। দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে আমাদের বিভিন্ন আইনী জটিলতায় পড়তে হয়। তাই আইন কানুন সম্পর্কে জ্ঞান রাখা আবশ্যক। আইন জানা আমাদের জন্য এমন অপরিহার্য্য বিষয় হলেও আইন জানার জন্য আমাদের দেশে ভাল কোন প্ল্যাট ফর্ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয় বা ল কলেজ গুলোর বিষয় আলাদা। তাই সাধারণ মানুষের দোর গোড়ায় টুকিটাকি আইন কানুন পৌছে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই ২০১৮ সালের ফ্রেব্রুয়ারী মাসে লিগ্যাল ভয়েসের যাত্রা শুরু। আইন সচেতন সোনার বাংলা গঠন করাই লিগ্যাল ভয়েসের মূল উদ্দেশ্য। বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে লিগ্যাল ভয়েস সাধারণ মানুষের আইন শেখার পিপাসা নিবারণ করে থাকে। এ ছাড়া লিগ্যাল ভয়েস যে কোন ধরনের আইনগত সমস্যায় বিনা খরচে পরামর্শ প্রদান করে থাকে। আমাদের সাথে থাকার জন্য সকল পাঠককে আন্তরিক শুভেচ্ছা ।